ঢাকা: রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের ভাওয়াল বনে মিললো বিরল প্রজাতির মাশরুম। বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার ও আঞ্চলিক নাম চয়ন করে গবেষক এর নাম দিয়েছেন ‘বড়ফুটুস ঢাকানুস’।
বাংলাদেশের শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও চীনে (Kunming Institute of Botany, Chinese Academy of Sciences) উচ্চতর শিক্ষাকালীন সময়ে তরুণ গবেষক মোঃ ইকবাল হোসেন চমকপ্রদ এই উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
ইকবাল উদ্ভাবিত বোলেটাসেয়ী পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জেনাস/গণ ‘বড়ফুটুস’ উন্মূক্ত করেছে অর্থনৈতিক ও বিজ্ঞান গবেষণায় বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। বিজ্ঞান গবেষকরা মনে করছেন, তরুণ এই গবেষকের উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে অধিকতর গবেষণায় উন্মোচন হতে পারে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
প্রভাবশালী বিজ্ঞান সাময়িকী ‘Fungal Diversity’ ড. ইকবালের এ সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশি এই তরুণ গবেষকের সাফল্যের খবর।
সম্প্র্রতি ড. ইকবাল হোসেন বহুমাত্রিক.কম-কে জানিয়েছেন তাঁর এই গবেষণার আদ্যোপান্ত। তিনি তুলে ধরেছেন আবিষ্কৃত প্রজাতির বৈশিষ্ট্য, নামকরণের প্রেক্ষাপট ও বিজ্ঞান গবেষণার সম্ভাবনার দিকসমূহও।
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘‘দেশে এ পর্যন্ত শনাক্তকৃত ঠিক কোনটি কত প্রজাতির মাশরুম রয়েছে তা বলা কঠিন। এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই নেই।’’
গবেষণার উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে,
বোলেটাসেয়ী পরিবারের পৃথিবীতে মোট ৫৫টি জেনাসের (Genus=গণ) মধ্যে বাংলাদেশে ১০টি বিদ্যমান। এর মধ্যে একটি ভাওয়াল বনে আবিষ্কৃত হওয়া ‘বড়ফুটুস’। যা পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ‘বড়ফুটুস ঢাকানুস’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে। ’’
নামকরণ
বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন শ্রেণী, প্রজাতি-উপপ্রজাতি ইত্যাদির নাম চয়ন অন্যান্য প্রথাগত বিষয়ের মতো নয়। এখানে আন্তর্জাতিক ভাবে বিজ্ঞানপরিমন্ডলের রীতি অনুসৃত হয়। আমাদের গবেষক ইকবাল হোসেনের নতুন জেনাসের মাশরুমের নাম নির্বাচনে তেমনি রীতি অনুসরণ করা হলেও এখানে গবেষকের দেশপ্রেমের আন্তরিক স্বরূপটি ফুটে উঠেছে।
বহুমাত্রিক.কম-র কাছে ইকবাল হোসেন এই নামকরণের প্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন সবিস্তারে। তিনি জানান, বোলেটাসেয়ী পরিবারের মাশরুমগুলোর হাইমেনোফোর মূলত ল্যামেলি দ্বারা গঠিত না হয়ে টিউব দিয়ে গঠিত গঠিত হয়ে থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে; যেমন- Phylloporus.
নাম চয়নে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গ বর্ণনা করে গবেষক ইকবাল জানান, জেনাস/গণ "Borofutus"(বড়ফুটুস) শব্দটি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা থেকে নেওয়া হয়েছে। যেখানে "বড়" (Boro) এবং "ফুটো" (Futo)-এই দু’টি শব্দের সমন¦য়ে গঠিত হয়েছে "বড়ফুটুস"।’’
‘‘কেননা বোলেটাসেয়ী পরিবারের যতগুলো মাশরুম রয়েছে তার মধ্যে এটার একটি একক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আর তা হলো, এর হাইমেনোফোর বড় বড় ছিদ্র দ্বারা গঠিত। প্রজাতি "dhakanus" শব্দটি "ঢাকা" (Dhaka) হতে নেওয়া হয়েছে, কারণ এটি ঢাকার অদূরে গাজীপুর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে’’-যোগ করেন ড. ইকবাল।
``Borofutus dhakanus``-র অনন্য সব বৈশিষ্ট্য
তাবৎ বিশ্বের বিজ্ঞান গবেষকদের কাছেই বাংলাদেশ এক ‘‘ইউনিক ডেল্টা’ হিসেবেই পরিচিত। জগতবিখ্যাত কোনো এক বিজ্ঞানী বাংলাদেশ সফরে এসে তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘‘এই দেশের কোথায় পা ফেলবো। এদেশের প্রতিটি ঘাস-লতাগুল্মই তো অন্যন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, হয়তো দূরারোগ্য কোনো ঔষুধের উপকরণ। এখানে পা ফেলা মানে ঔষধের উপকরণ নষ্ট করা।’’
তবে অন্য দেশের নাগরিক-বিজ্ঞানী এই সত্য উপলব্ধি করলেও আমরা হেলায় নষ্ট করেছি এবং করছি আমাদের অনন্য জীববৈচিত্র্যকে। গবেষকদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রচেষ্টা, বনদস্যুতা আর ভূমিদস্যুতায় এরই মধ্যে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য নাম লিখেয়েছে বিলুপ্তির খাতায় এবং এ তালিকা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে।
ভাওয়ালের বনাঞ্চলে গবেষক ইকবাল হোসেনের আবিষ্কৃত মাশরুমের জেনাসটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের-অত্যন্ত বিরলও বটে। গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, ‘বড়ফুটুস ঢাকানুস’র পিলিয়াস ছোট হতে মাঝারি আকারের হয়ে থাকে, যার উচ্চতা/দৈর্ঘ্য (৩০-৬০ মিলিমিটার), পিলিয়াস ৩০-৬৫ মিলিমিটার, বাদামি, কিছুটা ধুসর অথবা কোকোয়া বর্ণের হয়ে থাকে। এটির হাইমেনোফোর ল্যামেলির পরিবর্তে টিউব দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে, টিউবগুলো কা-ের সাথে কিছুটা যুক্ত থাকে এবং ২-৬ মিলিমিটার প্রসস্থ হয়ে থাকে এবং তা হলুদ থেকে সোনালি-বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, কান্ডটা কিছুটা ধুসর বর্ণের এবং ব্যাসিডিওস্পোর গুলোর উপরিভাগে কিছুটা সূক্ষ্ম গর্ত দেখা যায়। হাইমেনিয়াল সিস্টিডিয়া সাধারণত ল্যাজেনি অর্থ্যাৎ গোড়ার দিকে কিছুটা স্ফীত এবং উপরের দিকে চিকন আকারের হয়ে থাকে। এটি মলিক্যুলার ফাইলোজেনেটিক্যালি খুব কাছাকাছি Spongiforma জেনাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা ২০০৯ সালে থাইল্যান্ড থেকে আমেরিকান মাইকোলজিস্ট Dr. Dennis E. Desjardin আবিষ্কার করেছেন।
‘বড়ফুটুস’-কে ঘিরে যতো সম্ভাবনা
অনন্য বৈশিষ্টের মাশরুম প্রজাতি ‘ বড়ফুটুস ঢাকানুস’ আবিষ্কার বা শনাক্তকরণের মধ্য দিয়ে নানামাত্রিক উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গবেষক ইকবাল হোসেনের মতে, এই প্রজাতির শনাক্তকরণের মাধ্যমে প্রথমত আমাদের দেশে কী ধরণের এবং কী পরিমাণের মাশরুমের বিভিন্নতা রয়েছে তার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে তরুণ গবেষকদেও অনুপ্রাণিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দ্বিতীয়ত: বিভিন্ন প্রজাতির মাশরুম বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বেই শনাক্তকরণ, সংরক্ষণ করা এবং বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় অবদান রাখা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন প্রকারের মাশরুম পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের পুষ্টি যোগানে সহায়তা করে অর্থাৎ বৃক্ষকে সবল-সতেজ রেখে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।
খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশে মাশরুম ইতোমধ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে দাবি করে ইকবাল হোসেন বলেন, ‘‘উচ্চ ঔষধিগুন সম্পন্ন হওয়ায় একে ঔষধশিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার নতুন সাফল্যের জন্ম দিবে বলে আশা করা যায়।’’
তরুণ এই গবেষক আরো মনে করেন, বর্তমান গবেষণার ফলকে সামনে এগিয়ে নেওয়া গেলে, এই প্রজাতি নিয়ে আরো অধিকতর গবেষণা হলে এবং পৃষ্ঠপোষক-উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে একে নিয়ে অনেকদূর যাওয়া সম্ভব। তারমতে, সীমিত আকারে মাশরুম উৎপাদনের যে চেষ্টা দেশে এখন হচ্ছে, তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়ে কোনো এক সময় আধুনিক চীনের মতো বিশাল মাশরুম শিল্প গড়ে উঠতে পারে।
দেশে-বিদেশে মাশরুম
আমাদের দেশে মাশরুম গবেষণার ইতিহাস যে খুব দীর্ঘ তা নয়। তবে বিশ্বজুড়ে মাশরুমের গবেষণা, বাণিজ্যিক চাষাবাদ, সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ, ঔষধ শিল্পে ব্যবহার ইত্যাদির প্রচলন বেশ পুরনো।
এদিক থেকে, চীন, জাপান, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলো অনেক এগিয়ে। ২০ বছর পূর্বেকার এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে ১.৫ মিলিয়ন ছত্রাক রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় এর পরিমাণ ২-২.৩ মিলিয়নেরও উপরে এবং যার মাত্র শতকরা ৫-৭ ভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে।
এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয়, পৃথিবীতে এখনো অনেক মাইকোবায়োটা অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি বছর নতুন ছত্রাক রেকর্ডের পরিমাণ ১০০০-১২০০ টি। যদি বিশ্বে আনুমানিক ১.৫ মিলিয়ন ছত্রাকের পরিমাণ সঠিক হয় এবং অন্যান্য উপাদান সত্য থাকে, তাহলে মিসিং ১.৫ মিলিয়ন ছত্রাকের নথিভুক্ত করতে প্রায় ১০০০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। এদের কোনো কোনোটি প্রকৃতিতে পরজীবি, মৃতজীবি এবং মিথোজীবি হিসেবে কাজ করে।
মাশরুমের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ক্যালরিযুক্ত খাদ্য হিসেবে কাঁচা ও রান্না-উভয়ভাবেই মাশরুম খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। নিরামিষভোজীদের কাছে মাশরুম মাংসতুল্য। চীন, কোরিয়া, জাপানে মাশরুম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন সুস্বাদু খাদ্য তৈরিতে সহ-উপাদান হিসেবে এর ব্যবহার প্রচুর।
বিদেশের সুপারশপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাম্প্রতিকালে বাংলাদেশেও সুপারশপে মাশরুমের বিপণন চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন এনজিও’র সহযোগীতায় ও অনেক উৎসাহী কৃষক মাশরুম চাষে সন্তোষজনক সাফল্য দেখাচ্ছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাবারের বৈচিত্র্যতা আনতে ও ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণে মাশরুম চাষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বহুমাত্রিক.কম