ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন
ঢাকা : ভাল গান দিয়ে শুদ্ধ মনন তৈরীর অঙ্গীকারে পঞ্চমবারের মতো রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাচ্ছে বহুল প্রতিক্ষিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’। প্রথমবারের মতো এবারের উৎসবে আসছেন শাস্ত্রীয়সংগীতের অনেক দিকপালরা।
দেশের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিসরের এই উচ্চাঙ্গসংগীত আসর আগামী ২৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলবে ২৮ নভেম্বর প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। এবছর এই উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে (১৯৩৫-২০১৬)।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্তাব্যক্তিরা।
সংবাদ সম্মেলনে এই আয়োজনের প্রেক্ষাপট-তাৎপর্য তুলে ধরেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। এবারের আয়োজনের নানা তথ্য উপস্থাপন করেন ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।
এসময় স্কয়ার গ্রুপ ও মাছরাঙা টেলিভিশনের পক্ষে ছিলেন অঞ্জন চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন জারা মাহবুব ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ড. আবুল মোমেন।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব উপলক্ষে bengalclassicalmusicfest.com নামে ফেস্টিভালের নতুন ওয়েবসাইট উন্মোচন করা হয়েছে যাতে বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউসিক ফেস্টিভাল এর সকল তথ্য পাওয়া যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের গুরু পণ্ডিত কুশল দাশের গৎ রচনায় শিক্ষার্থী-মেহরিন আলম, আশিষ নারায়ণ সরকার, টি.এম. সেলিম রেজা, নিশীথ দে, শ্যামা দে, জ্যোতি ব্যানার্জি, প্রসেনজিৎ মণ্ডল, আহমেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, খন্দকার নাজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ এবং মোহাম্মদ কাওসার সেতারে একটি সংক্ষিপ্ত পরিবেশনা উপস্থাপন করেন। তাঁদের তবলায় সহযোগিতা করেন সুপান্থ মজুমদার ও প্রশান্ত ভৌমিক।
এবারের ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’র বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, এবারের উৎসবের উল্লেখযোগ্য দিক নবীন শিল্পীদের উপস্থিতি ও একাধিক যৌথ পরিবেশনা।
তিনি জানান, এবার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসছেন বিশ্ববিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আলি আকবর খাঁর পৌত্র ওস্তাদ আশিষ খাঁ। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের প্রথম দিন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ তাঁকে তবলায় সংগত করবেন। উৎসবে এবারও আসছেন প্রবাদপ্রতিম বিদুষী গিরিজা দেবী।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জয়পুর আত্রৌলির বিদুষী অশ্বিনী ভিদে ও মেওয়াতি ঘরানার পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ঙ্কর এবার একই মঞ্চে ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করবেন। পণ্ডিত জসরাজ যুগলবন্দির একটি বিশেষায়িত রূপ ‘জাসরাঙ্গি’ প্রচলন করেন, যেখানে পুরুষ ও নারী কণ্ঠে একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন স্তরে রাগ পরিবেশন করা হয়।
এবারের উৎসবে প্রথম দিনের শেষ শিল্পী পদ্মভূষণ ড. এল সুব্রহ্মণ্যন। পশ্চিমা ও কর্ণাটকি ঢংয়ে সমান পারদর্শিতার সঙ্গে বেহালা বাজিয়ে থাকেন তিনি। গ্র্যামি নমিনেশন পাওয়া পাওয়া স্বনামধন্য এই শিল্পী বিশ্বের নামিদামি সব কম্পোজার ও কন্ডাকটরের সঙ্গে বাজিয়েছেন।
প্রেরণাসঞ্চারী ওডিশি নৃত্যের জন্য খ্যাতি লাভ করেছেন বিদুষী মাধবী মুডগাল। এবার উৎসবে মঞ্চে আসবেন তিনি ও তাঁর শিষ্যা আরুশি মুডগাল।
অন্যান্যবারের মতো এবারও উৎসবে মনমুগ্ধকর পরিবেশনা নিয়ে হাজির হবেন প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা ও পুত্র রাহুল শর্মা, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত উল্লাস কশলকর, ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত কুশল দাস, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকার।
কিরানা ঘরানার বরেণ্য শিল্পী কোকিলকণ্ঠী পদ্মভূষণ ড. প্রভা আত্রে, র্ফারুকাবাদ ঘরানার স্বনামধন্য তবলিয়া পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর পুত্র অনুব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট সেতারিয়া পণ্ডিত সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবার আসছেন তাদের পরিবেশনা নিয়ে।
শিল্পী প্রবীণ গোধকিন্ডি ও রাতিশ টাগডের বাঁশি ও বেহালায় এবং খ্যাতিমান পণ্ডিত যোগেশ শামসী ও পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তবলায় যুগলবন্দি করবেন।
এই উৎসবে বাঁশি ও ম্যান্ডোলিনের যুগলবন্দি শোনাবেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড নমিনি বাঁশিশিল্পী পণ্ডিত রনু মজুমদার ও ম্যান্ডোলিনের বিশিষ্ট রূপকার প্রয়াত ইউ শ্রীনিবাসের ভ্রাতা ইউ রাজেশ।
সেতারে রাগসংগীতের স্বতন্ত্র রূপকার নন্দিত শিল্পী পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়, কর্ণাটকি সংগীতে পারদর্শী ভগ্নিদ্বয় রঞ্জনী ও গায়ত্রী, প্রতিষ্ঠিত কর্ণাটকি বংশীবাদক শশাঙ্ক সুব্রহ্মণ্যন এবং খেয়ালিয়া আরতী আঙ্কালিকার, জয়তীর্থ মেউন্ডি ও কুমার মারদুর পাঁচদিনের উৎসবে পরিবেশন করবেন বিভিন্ন মেজাজের শাস্ত্রীয়সংগীত।
উৎসবের প্রবীণতম শিল্পী ৮৭ বছর বয়সী বিদুষী গিরিজা দেবী। কনিষ্ঠতম শিল্পী ইসরাত ফুলঝুরি খান। তাঁর বয়স সাত বছর। তিনি পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের দলীয় সরোদ পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করবেন। স্বনামধন্য এস্রাজ শিল্পী ওস্তাদ ইয়ার রসুল খাঁর ওরফে ফুলঝুরি খাঁর দৌহিত্রী তিনি।
উৎসবে বাংলাদেশি শিল্পীদের অংশগ্রহণ
বাংলাদেশের ১৬৫ জন শিল্পী এবার উৎসবে অংশগ্রহণ করবেন। উৎসবের উদ্বোধনী পর্বে স্বনামধন্য নৃত্যশিক্ষক শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ও নির্দেশনায় নৃত্যনন্দন দলের প্রায় ষাটজন শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল গান ও ভাঙ্গা গানে মণিপুরী, ভরতনাট্যম, ওডিশি ও কত্থক রীতির রূপায়ণ পরিবেশন করবেন।
প্রথিতযশা শিল্পী মুনমুন আহমদ তাঁর দল নিয়ে কত্থক পরিবেশন করবেন উৎসবের চতুর্থ দিন। বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী প্রিয়াংকা গোপ এককভাবে খেয়াল এবং তাঁরই নির্দেশনায় দলগতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা শাস্ত্রীয়সংগীত পরিবেশন করবেন শেষ দিন।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন মোহাম্মদ শোয়েবের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে নিরীক্ষামূলক রাগসংগীত উপস্থাপন করবেন। বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দিনে দলীয়ভাবে সেতার, সরোদ ও তবলা পরিবেশন করবেন।
আয়োজকরা জানান, বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পঞ্চম অধিবেশন উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, এমপি। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমপি, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন। সূচনা বক্তব্য রাখবেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
উৎসব প্রাঙ্গণে প্রবেশ
আগামী ২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিবারের মতো অনলাইনে নিবন্ধন করে উৎসবে বিনামূল্যে প্রবেশের পাশ সংগ্রহ করতে হবে। নভেম্বর মাসের শুরু থেকে সীমিত সময়ের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন চলবে।
যাদের ইন্টারনেট সংযোগ নেই তারা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধানমন্ডি ৭/এ সড়কে অবস্থিত জ্ঞানতাপস আব্দুুর রাজ্জাক বিদ্যাপিঠ (বাড়ি নং ৬০, সড়ক নং ৭/এ, ধানমন্ডি) এবং এয়ারপোর্ট রোড খিলক্ষেতে অবস্থিত বেঙ্গল সেন্টারে (প্লট ২, সিভিল এভিয়েশন এরিয়া, এয়ারপোর্ট রোড) নিবন্ধন করতে পারবেন।
অনুষ্ঠানের প্রথম দুদিন পর্যন্ত অফ-সাইট নিবন্ধন চলবে। তৃতীয় দিন থেকে এ সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানস্থলে নিবন্ধন করা যাবে না। প্রতিদিন রাত ১টায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া আগের বছরগুলোর মতো ভোরে আর্মি স্টেডিয়াম থেকে ফেরার জন্য নির্দিষ্ট রুটে বাস থাকবে।
নিরাপত্তার স্বাথে মাঠে ব্যাগ নিয়ে ঢোকা যাবে না। মাঠে ব্যাগ রাখার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। ঢোকার সময় সব গেটে পূর্ণাঙ্গ সিকিউরিটি চেক হবে। প্রত্যেককে নিজের সঙ্গে কোনো প্রকার সনাক্তকরণ পরিচয়পত্র রাখার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
মাঠে পেশাদার ক্যামেরা (নিবন্ধিত ফটো সাংবাদিক ব্যতীত), খাবার, কোনো প্রকার পানীয় বা ধূমপানের সরঞ্জাম নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না।
এছাড়া স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। আর্মি স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ এবার স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ নতুন করে সংস্কার করেছেন। এর ফলে আরো উন্নতমানের সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। বয়স্ক বা হাঁটাচলায় যাঁদের অসুবিধা আছে, তাঁদের প্রধান ফটক থেকে হুইলচেয়ারে আনার ব্যবস্থা থাকবে।
বহুমাত্রিক.কম