
পর্তুগাল থেকে : প্রতিদিন খবরের কাগজ হাতে নিলে দেখা যাচ্ছে, করোনা রোগের ভয়ে সন্তানেরা মা কে বনে ফেলে চলে যাচ্ছে, মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেয়া হচ্ছে, করোনা রোগীদের জন্য চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় জনগণ বাধা দিচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুর পাড়ে আলাদা থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং করোনা রোগীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে। একবার কি ভেবেছেন এর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? একটি সভ্য সমাজেতো এমন হবার কথা নয়। তবে কেন মানুষ এমন আচরণ করছে? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখি।
সাধারণত মানুষ যখন বিপদে পরে কিংবা কোনোকিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভয়ে থাকে অথবা কোনো ঘোর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয় তখনি মানুষ আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর হয়ে উঠে। সবসময় নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে এতটাই মরিয়া হয়ে উঠে যে, তখন সে তার হিতাহিত জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলে। অবিবেচক কিংবা বিবেকহীনের মতো আচরণ করে। তার কাছে তখন সম্পর্ক, মনুষ্যত্ব এবং নৈতিকতার থেকেও নিজের স্বার্থ বড় হয়ে উঠে। একরকম "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা" অবস্থা। এখন কথা হলো, মানুষের এমনটা কেন হচ্ছে? মানুষ করোনা রোগী কিংবা করোনা রোগীর সাথে সম্পৃক্ত লোকজনের দিকে কেন এমন বৈরী আচরণ করছে? এর বিভিন্ন কারণ হতে পারে।
করোনা রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমরা অনেকেই এখনো পুরোপুরি জানিনা যে এই রোগ কি করে ছড়ায় কিংবা কোথা থেকে একজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রকৃত তথ্য না জানার ফলে আমরা যে যার মতো চিন্তা করে নিচ্ছি। একেকজনের মানসিকতার উপর নির্ভর করে একেকরকম ভাবে আচরণ করছি। কেউ ভালো কেউ খারাপ। আমরা অনেকেই এই মহামারী নিয়ে মনগড়া তথ্য দিচ্ছি। যে যার মতো ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিচ্ছে। না জেনে নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করতে ব্যস্ত হচ্ছে। যার এই বিষয়ে নূন্যতম জ্ঞান আছে সে তো বলছেই, এমনকি যে এই বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ সেও একইভাবে পান্ডিত্য দেখাচ্ছে। যা মানুষকে প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে সচেতন করার বিপরীতে ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। ফলে মানুষ অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে।
দ্বিতীয়ত, করোনার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক না থাকা এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও কুসংস্কারের প্রভাব। যেহেতু এই রোগের কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই রোগ নিয়ে আতঙ্কিত এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছে । আর এই সুযোগে অনেকেই ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে করোনা নিয়ে বিভিন্ন রকমের মতামত দিয়ে যাচ্ছে। যেমন "করোনা কেবল পাপী মানুষের হয়"। এখন যে বা যারা এই মতামত দিয়েছে, তারা কি করে নিশ্চিত হলো যে এই রোগ কেবল পাপী ব্যক্তিরই হয়? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ মানুষেরই ধর্মীয় জ্ঞান সীমিত, তারা নিজেদের সুবিধার্তে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থকে নিজেদের মতো অপব্যাখ্যা করে নিজেদেরকে সঠিক প্রমান করার চেষ্টা করছে এবং সাধারণ মানুষ তাদেরকে বিশ্বাসও করছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে করোনা রোগীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব এবং ঘৃণা তৈরী হচ্ছে।
তৃতীয়ত, গুজব ছড়ানো। করোনা রোগ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই পাওয়া যায়। এমন এমন সব তথ্য যা শুনলে বা দেখলে রীতিমতো শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। কেউ কেউ জেনে বুঝে নিজস্বার্থে এইসব মিথ্যা তথ্য ছড়ায় আবার কেউ কেউ না জেনে বা না বুঝে এই তথ্য অন্যের সাথে শেয়ার করে। একসময় গুজব এমন অবস্থায় চলে যায় যে গুজব সত্যের চেয়েও বেশি সত্য মনে হয়। ফলে সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করে। বর্তমান পরিস্থিতি এর ব্যতিক্রম নয়।
চতুর্থত, হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া। রোগ হলে চিকিৎসা নিতে মানুষ হাসপাতালে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই পাল্টে গেছে হাসপাতালের সাধারণ চিত্র। মানুষ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত আসছে। ফলে গণমনে করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। এমনকি বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হবে বলে গণমনে একধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। যা মানুষকে ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর করে তুলছে। মানুষ নিজেকে বাঁচাতে, একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না, উল্টো করোনা আক্রান্ত রোগীকে শত্রু বলে গণ্য করছে।
পরিশেষে, গণমাধ্যমের অনুপযুক্ত শিরোনাম এবং অতিরঞ্জিত শব্দ চয়ন। প্রায়ই গণমাধ্যমে এমন এমন কিছু শিরোনাম চোখে পরে যা নির্দিষ্ট প্রতিবেদনের থেকে আলাদা। শুধু মাত্র পাঠকদের নজরে আসতেই এমন সব শিরোনাম ব্যবহার করা হয়। যেহেতু আজকাল প্রায় সব গণমাধ্যমেরই সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ রয়েছে সেহেতু পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছাতে এই খবর সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে পোস্ট করা হচ্ছে। ফলে বিপুলসংখ্যক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী শিরোনাম দেখে বিস্তারিত না পড়েই ভুল তথ্য ধারণ করছে। একইসাথে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে বাড়াবাড়ি। যেমন "----স্থানে করোনার হানা/প্রকোপ/থাবা/তান্ডব", "করোনা গ্রাস করলো পুরো পরিবার", ইত্যাদি। সাধারণত (হানা,প্রকোপ,থাবা,তান্ডব এবং গ্রাস করা) এই ধরণের শব্দগুলো মানুষের মনে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি ভয়ের সৃষ্টি করে। আর ভয়ের থেকেই তৈরী হয় স্বার্থপর মনোভাব। সুতরাং গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও এমন আরও অনেক কারণ থাকতে পারে যা চাইলে আমাদের মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীগণ খুঁজে দেখতে পারেন। সবাই কেন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের পথে হাঁটতে পারলেই কেবল এই সামাজিক সংকট থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।
লেখক: , পর্তুগাল প্রবাসী
ইমেইল: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম