ফাইল ছবি
দেশের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ ধানের জোগান আসে হাওর থেকে। কিন্তু ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পুরোনো বিপদ এবারও কৃষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ বড়সংখ্যক জমির ধান এখনও কাটা বাকি। বিপদ আঁচ করতে পেরে কৃষি মন্ত্রণালয় হাওরের ধান ৮০ শতাংশ পাকলেই, তা ২৫ এপ্রিলের মধ্যে কাটার নির্দেশনা দিয়েছে।
এরপর স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন তৎপর হয়েছে। সব ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানকে প্রয়োজনে মাইকিং করে হলেও ধান কাটা শুরুর আহ্বান অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। ধান কাটার কাজে যাতে ছেদ না পড়ে, সে জন্য সব রকম সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত খোদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে, হাওরভুক্ত সাত জেলার নিচু জমির ২৮ দশমিক ০৩ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ২৯ দশমিক ৮৬, মৌলভীবাজারে ২৫ দশমিক ০৪, হবিগঞ্জে ১০, সুনামগঞ্জে ২৭ দশমিক ৮০, নেত্রকোনায় ৫৪ দশমিক ৯৪, কিশোরগঞ্জে ২৪ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৫ দশমিক ০৬ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এ ছাড়া এসব জেলার হাওর ছাড়া উঁচু জমিতে ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে।
শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান গোলায় তোলার প্রস্তুতি নেওয়া কৃষকরা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বৈশাখজুড়ে হাওরে উৎসব থাকবে। তবে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২২ এপ্রিলের পর সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। এতে হাওরের কিছু নিম্নাঞ্চলের ধান পানিতে ডুবে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার ধান কাটা ও বাঁধ নির্মাণ পরিস্থিতি দেখতে সুনামগঞ্জে যাচ্ছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।
সিলেট বিভাগে মাত্র ২০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোশাররফ হোসেন খান। তিনি জানান, বিভাগের হাওর ও নন-হাওর মিলিয়ে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্ধেক ধান পেকে এসেছে।
সিলেটের ওসমানীনগরে হাওর এলাকার ৪০ ভাগ ও নন-হাওরের ৫ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উম্মে তামিমা। কোম্পানীগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং জানান, হাওরে প্রায় ৪০ ও নন-হাওরে ১০ ভাগ কাটা হয়েছে। ৮০ ভাগ ধান পাকা হলেই কাটার বিষয়ে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত দেবনাথ জানান, উপজেলার ৫ হাওরে ৬ হাজারের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে।
বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিচ্ছিন্নভাবে ধান কাটা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ মাড়াই করছেন। বৃষ্টি শুরু হলে ধান কাটতে সমস্যায় পড়বেন বলে মনে করছেন তাঁরা। সপ্তাহখানেক সময় পেলে অধিকাংশ হাওরের ধান কাটা শেষ হবে বলে আশাবাদী চাষিরা।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরপাড়ের হাওরি আলীপুরের বড় কৃষক আয়না মিয়া ধান কেটে গোলায় তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘দুই ভাই, ছেলে-ভাতিজাসহ ৮ এবং আরও সাতজন কামলা লইয়া পতা (সেহরি) খাইয়া কাম শুরু করি, ইফতার করি খলাতে (ধান মাড়াই-শুকানোর অস্থায়ী স্থান)। দিনে এক হাল (চার একরে এক হাল) কইরা ধান মেশিনে কাটের, এর বেশি কাটলে টাওয়ানি (ঘরে ধান এনে রাখা) যাইত নায়। জানে মইরা (প্রাণপণ চেষ্টা) চেষ্টা কররাম, এরপরে আর গেলেই (পানিতে ডুবলে) কিতা করমু, আল্লায় মারলে কোনতা (কিছুই) করার নাই।’
জামালগঞ্জ কৃষি অফিস থেকে বন্যা হতে পারে জানিয়ে ফোন করে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে ধান কাটা শেষ করতে বলেছে। এ জন্য উৎকণ্ঠায় আয়না মিয়া। তিনি বলেন, পরিবারের সবাই মিলে দিনে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাটলেও ছয় দিনে শেষ হবে না। তা ছাড়া ব্রি-২৯সহ কিছু ধান পাকতে আরও চার-পাঁচ দিন লাগবে।
বিশম্ভরপুরের করচার হাওরপাড়ের ব্রজনাথপুরের কৃষক সুধাংশু বিশ্বাস জানান, তাঁর ৯ কেয়ার জমির তিন কেয়ার ব্রি-২৮ ও ব্রি-৮১ করেছিলেন, সেগুলো কাটা হয়ে গেছে। তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওর পারের বড়দল নতুনহাটির কৃষক মিলন মিয়া জানান, ছয় দিন সময় পেলেই ৯০-৯৫ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। তাহিরপুরের শনির হাওর পারের কৃষক ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মহসিন মিয়া জানান, তাঁদের হাওরে এ পর্যন্ত ২৫ ভাগ ধান কাটা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, জেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে নানা জাতের বোরো ধান আবাদ হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত জেলায় ৪৭ হাজার ৩৯ হেক্টর জমির ধান (২১.১১ শতাংশ) কাটা শেষ। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময় পেলে ৭০ ভাগ কাটা ছাড়াবে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের সুতারপাড়া হাওরে দেখা গেছে, ব্রি-২৮ কাটা প্রায় শেষ। হাইব্রিড হীরাসহ ব্রি-২৯ এখনও কাঁচা। হীরা এক সপ্তাহের মধ্যে কাটা গেলেও ব্রি-২৯ দুই সপ্তাহ লাগবে। কিছু ধান কাটতে আরও অন্তত তিন সপ্তাহ লাগবে।