ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জমির স্বল্পতা ও ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য স্থপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (আইএবি) নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্থাপত্য হল একটি সভ্যতার মাপকাঠি। প্রাচীন সভ্যতাকে চেনা বা জানার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে স্থাপত্য শিল্প। আজকে আমরা যা কিছু নির্মাণ করছি, কয়েকশ’ বছর পর
যদি এগুলো টিকে থাকে তাহলে এগুলো আমাদের সময়কে ধারণ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যা কিছু নির্মাণ করি না কেন, সেগুলোকে যেমন একদিকে হতে হবে স্থায়িত্বশীল, পরিবেশ বান্ধব অন্যদিকে তেমনি দৃষ্টি নন্দন। নান্দনিক বলেই মানুষ এখনও পুরানো রাজবাড়ি, মসজিদ, মন্দির দেখতে ছুটে যায়।
গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।
আর্কিটেক্ট রিজোনাল কাউন্সিল এশিয়ার সভাপতি সাথিরুত নুই টান্ডাহ্যান্ড, আইএবি সেন্টারের সভাপতি ড. আবু সায়ীদ এম আহমেদ, আইএবি’র সাধারণ সম্পাদক কাজী এম আরিফ, কাজী গোলাম নাসির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের স্থপতিদের এমন স্থাপত্য নির্মাণ করতে হবে, যা টেকসই ও মজবুতের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব হবে।’
হাসপাতাল, কলকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপত্যের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে স্থাপত্য নির্মাণের আগে দেশি কনসালটেন্টদের পরামর্শ নিতে বলেন।
তিনি বলেন, ‘বাইরের দেশের কনসালটেন্টদের চেয়ে আমাদের দেশের কনসালটেন্টরা দেশের আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো জানেন বা ভালো বোঝেন। তাই তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়াটাই ভালো।’
দ্রুত নগরায়নের ফলে চাষের জমি রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার গ্রাম এবং উপজেলা পর্যায়ের অবকাঠামো উন্নয়নে এ জন্য মাস্টার প্লান বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে স্থপতিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার সবার জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। সবার জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করাই সরকারের টার্গেট।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের একটা মানুষও কুঁড়ে ঘরে বাস করতে পারবে না। একটা টিনের ঘর হলেও দেব। আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে কত লোক এভাবে গৃহহারা আছে তাদের আমরা একটা ঘর দিতে চাই। সেইসাথে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিতে চাই। যাতে নিজেদের জীবনটাকে তারা উন্নত করতে পারে।’
তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলের লোকজনও উন্নত পরিবেশ, উন্নত জীবন ব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। যে কারণে সরকার গ্রামাঞ্চলেও সবরকম সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পাকা বহুতল দালান নির্মাণ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আবাসন সুবিধা প্রদানেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা দেশের আবহাওয়া জলবায়ু পরিবেশ সবকিছু মাথায় রেখেই কিন্তু একটা স্থাপনা হওয়া উচিত। যখন প্লান করা হয় বা ডিজাইন করা হয় আমাদের আর্কিটেক্টরাইতো ডিজাইন করেন, তারা যদি একটু লক্ষ্য রাখেন খাল নদী ভরাট না করে কিভাবে ডিজাইন করা যায়, তাহলে সত্যি আমাদের দেশটা রক্ষা পেতে পারে।’
আবাসন বা শিল্প কারখানা নির্মাণে যেন জলাধার ভরাট না হয় সেদিকে সচেতন হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে প্রস্তাবিত একশ`টি ইকোমিক জোন নির্মাণের পাশাপাশি এগুলোর সঙ্গে স্থাপন করা হবে বর্জ্য শোধনাগারও।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজধানীর জলাশয়গুলো সামরিক সরকারের শাসনামলে অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় রাজধানীতে বর্তমানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা যেমন দুর্বল তেমনি জলাবদ্ধতা তৈরি হয় ।
তিনি বলেন, ‘পুকুর বা জলাশয়ের সঙ্গেই যেন তাদের সব শত্রুতা।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আইয়ুব খান ঢাকার কেন্দ্রস্থল মতিঝিলের জলাশয় ধ্বংস করেন। আর এরশাদ ধ্বংস করেন পান্থপথের খাল।’
প্রধানমন্ত্রী স্থপতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, জলাশয় ভরাট না করে আমাদেরকে মাস্টার প্লানের আওতায় উন্নয়ন কাজ করতে হবে। নগরীতে ভবন নির্মাণে আপনাদেরকে আরো যতœবান হতে হবে।
আমাদের দেশে বাড়ি ঘরে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী, এয়ার কন্ডিশনের ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য ভবন নির্মাণের সময় পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের দিকে লক্ষ্য রাখার জন্যও স্থপতিদের প্রতি আহবান জানান।
তিনি আজকের দিনে ভবন নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল মন্তব্য করে স্থপতিদের ইটের পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা যায় কি না এবং নির্মাণ ব্যয় আরো কমানো যায় কি না, সেদিকে লক্ষ্য রাখার আহবান জানান।
তিনি একইসঙ্গে পুরাতন স্থাপত্যকলাকে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ উল্লেখ করে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসার জন্যও স্থাপত্যবিদদের প্রতি আহবান জানান।
ব্রিটিশ যুগে তৈরি লাল দালানগুলো বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে ধারণ করে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রয়োজন না থাকলে এসব ভেঙে ফেলা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশদের গোলামি করেছি দুইশ` বছর। আর ব্রিটিশদের সব স্থাপনা আমাদের রক্ষা করতে হবে এটা আমি মনে করি না। হয়তো প্রতীকী হিসেবে দুই-চারটা রাখতে পারি। বাকিগুলো ভেঙে নতুন চিন্তা, নতুন চেতনায় ভালো ভালো ভবন নির্মাণ করতে হবে।’
তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত করতে তাঁর সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে সর্বত সহযোগিতা করতেও স্থপতিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।