ছবি: সংগৃহীত
বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সঙ্গীতের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ। সুবৃহৎ বঙ্গে প্রাচীন কবিদের হস্তে উৎকীর্ণ জনজীবনের যে আখ্যান বহু শতকের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও আমাদের চর্চার অংশ হয়ে উঠেছে। চর্যা গান জীবনের জয়গান গেয়ে চলেছে বহুকাল ধরে তাকেই আমাদের পুনর্জাগরণের অনুষঙ্গ করার অভিনব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভাবনগর ফাউন্ডেশন।
ভাবসাধকদের চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের ৫০০তম আসরপূর্তি উপলক্ষ্যে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত ৮ মে থেকে ১০ মে (২০২৪) পর্যন্ত ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে হয়ে গেল ‘চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪’। উৎসবটি শুরু হয়েছিল ৮ মে ২০২৪ বিকাল ৫টায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (বাংলা একাডেমি গেটের বিপরীতে) ভাবনগর সাধুসঙ্গের ৫০১তম আসরের মাধ্যমে। এই আসরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভাবসাধকদের চর্যাপদের গানের পাশাপাশি ভাবনগর সাধুসঙ্গের ইতিহাস এবং বাংলাদেশে চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের প্রাসঙ্গিকতা বর্ণনা করেন বিশিষ্ট লোক-সংস্কৃতি গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া।
এরপর সাধুসঙ্গের পক্ষে চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রেবেকা জে মানরিং-কে কাঁচাফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকৃতির ভেতর দিয়ে চর্যাসংগীত শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রধান অতিথি রেবেকা জে মানরিং, সম্মানিত অতিথি মিখাইল আই ইসলাম এবং ভাবনগর সাধুসঙ্গের ভাবসাধকেরা চর্যাপদের গান গাইতে গাইতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের গেট দিয়ে বের হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে পৌঁছান। সেখানে সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মূলপর্ব। এ পর্বের সূচনায় ভাবনগর সাধুসঙ্গের ভাবসাধকগণ সমবেত কণ্ঠে চর্যাপদের প্রথম পদটি পরিবেশন করেন এবং সাধিকা সৃজনী তানিয়া আদি বাংলায় চর্যাপদের রাগাশ্রয়ী গান পরিবেশন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন ভাবনগর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নূরুননবী শান্ত। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উৎসব উপদেষ্টা মিখাইল আই ইসলাম, সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রধান অতিথির ভাষণে ড. রেবেকা জে মানরিং বলেন, চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪-এ যোগ দিয়ে জীবনের প্রথমবার চর্যাপদের গান শোনার সৌভাগ্য হলো। এতে আমি আনন্দিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির ভাষণের উৎসব-স্মারক ‘ভুসুকু বঙ্গালী’র মোড়ক উন্মোচন করেন উপস্থিত অতিথিবৃন্দ। উল্লেখ্য, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তাদের বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে চর্যাপদের গান পরিবেশন করেন সাধকশিল্পী শাহ আলম দেওয়ান, শিলা মল্লিক, বাউল অন্তর সরকার প্রমুখ।
চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চর্যাপদ পুনর্জাগরণ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে আয়োজিত এই সেমিনার অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সভাপতিত্ব করেন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান। সেমিনারে যথাক্রমে চর্যা নৃত্যের পুনর্জাগরণ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লুবনা মারিয়াম, ফোকলোরতত্ত্ব, এথনোমিউজিকোলজিতত্ত্ব ও ইউনেস্কোর সেফগার্ডিং ফর আইসিএইচ কনভেনশনের আলোকে চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নূরননবী শান্ত এবং ভাবসাধকদের চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন ড. সাইমন জাকারিয়া।
পঠিত প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন সংগীতগুরু তপন মজুমদার, সাধকশিল্পী শাহ আলম দেওয়ান, ফকির আবুল হাশেম, অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক, অধ্যাপক ড. শোয়াইব জিবরান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গোলাম রববানী, ড. আলী এফ এম রেজোয়ান, ড. কমল খালিদ, কবি শাহেদ কায়েস, ড. সাইম রানা, কবি নজরুল ইশতিয়াক, জোবায়ের আবদুল্লাহ প্রমুখ।
সেমিনার অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চর্যাপদের গান পরিবেশন করেন সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শিলা মল্লিক এবং ভাবনগর সাধুসঙ্গের বিভিন্ন কেন্দ্রের সাধকশিল্পীগণ। উল্লেখ্য, সেমিনার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর ভাবনগর ফাউন্ডেশন থেকে সদ্য প্রকাশিত ‘ভাবনগর: ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ বেঙ্গলি স্টাডিজে’র নতুন সংখ্যার উন্মোচন করা হয়।
চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪-এর তৃতীয় ও সমাপনী দিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার ১নম্বর মহড়া কক্ষে বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চর্যাপদ প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন ড. সাইমন জাকারিয়া। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাট্যনির্দেশক, চলচ্চিত্রকার, লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, চর্যাপদের চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারি। যে ঐতিহ্যে গান, নাচ ও নাটকের পাশাপাশি সংগীত পরিবেশনের বাদ্যযন্ত্র ও নাটকের আহার্য সম্পর্কেও তথ্য পাই, সেই সঙ্গে বাউল-ফকির সাধনার প্রাচীনত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি।
চর্যাপদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইম রানা পটমঞ্জরী রাগে চর্যাপদের ৭ সংখ্যক পদ ও সাধিকা সৃজনী তানিয়া চর্যাপদের ১ সংখ্যক পদ আদি বাংলায় এবং শাহ আলম দেওয়ান চর্যাপদের ১৩সংখ্যক চর্যাপদ ও বাউল অন্তর সরকার চর্যাপদের ৩৮সংখ্যক পদ সমকালীন বাংলায় রূপান্তরিত চর্যাসংগীতের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। চর্যাপদ পুনর্জাগরণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অর্ধশতাধিক শিল্পীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একই দিন সন্ধ্যা ৭টা শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে আনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে চর্যাপদের পুনর্জাগরণ আসর অনুষ্ঠিত হয় । শুরুতে সূচনা বক্তব্যে ভাবনগর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নূরুননবী শান্ত বলেন, চর্যাপদের গান আত্মশুদ্ধির গান। এই গানের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে নতুনভাবে ভাব বিপ্লব সাধিত হচ্ছে।
তাঁর বক্তব্যের পর সমবেত কণ্ঠে চর্যাপদের প্রথম পদটি পরিবেশন করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত সাধক শিল্পী। এরপর পর্যায়ক্রমে চর্যাপদের বিভিন্ন পদ সংগীত আকারে পরিবেশন করেন চুয়াডাঙ্গার আব্দুল লতিফ শাহ, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, বরিশালের শাহ আলম দেওয়ান, ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের বাবুল আক্তার বাচ্চু, আফজাল হোসেন, ফারুক হোসেন বেল্লাল হোসেন, মানিকগঞ্জের বাউল অন্তর সরকার, শরিয়তপুরে শিলা মল্লিক, ইউসুফ মিয়া, আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, কুমিল্লার বাউল তাহমিনা, ঝিনাইদহের জ্ঞানহীন নাইম, ফতেহ কামাল, কিশোরগঞ্জের অন্ধ আল আমিন সরকার সিপাহী, সিদ্দিক ফকির, উজ্জ্বল মিয়া, জাকির চিশতি, রোকনউদ্দিন, পটুয়াখালীর আনিস মুন্সী, পাবনার ফকির আবুল হাশেম, পঞ্চগড়ের রবিউল হক প্রমুখ।
শেষে চর্যাপদ পুনর্জাগরণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করেন চর্যাপদ পুনর্জাগরণ উৎসব ২০২৪-এর উপদেষ্টা মিখাইল আই ইসলাম, উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল শিল্পী আব্দুল লতিফ শাহ, ভাবনগর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড সাইমন জাকারিয়া ও আবৃত্তি শিল্পী সানজিদা স্মৃতি।