ছবি: বহুমাত্রিক.কম
রীতি অনুযায়ী পৌষের শেষ বিকেলে বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে অবশেষে রাজা- জমিদার আমলের ঐতিহ্যবাহী ২৬৬তম ‘হুমগুটি’ খেলা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। প্রশাসন এবার খেলাটি বন্ধ রাখতে চেয়েছিল । খেলার অনুমতি না দিয়ে সেটি বন্ধ রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা করলেও এ খেলাকে
ঘিরে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।
মঙ্গলবার ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার বালিয়ান ইউনিয়ন ও দেওখলা ইউনিয়নের মাঝামাঝি লক্ষ্মীপুর বড়ইআটা এলাকায় এ খেলার আয়োজন করা হয়। স্থানটি জমিদারি আমল থেকে ‘তালুক-পরগনা সীমান্ত’ বলে পরিচিত। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত হুমগুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে
হুমগুটি খেলাটি প্রাচীনকাল থেকে এ এলাকার ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। প্রতিবছর পৌষের শেষ দিন তালুক-পরগনা সীমান্তে এ খেলার আয়োজন করা হয়। আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ খেলাকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠেন গ্রামের মানুষেরা। খেলা দেখতে গ্রামের বাড়িগুলোতে আসেন দূর–দূরান্তের স্বজনেরাও। মিলনমেলায় পরিণত হয় পুরো গ্রাম।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় হুমগুটি খেলার জন্য পিতলের গুটি আনা হচ্ছে মাঠে। মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার লক্ষ্মীপুর বড়ইআটা এলাকায়। কিন্তু দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এবারের হুমগুটি খেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। এমনটি জানিয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, গত সোমবার রাতে খেলাটি বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু সকাল থেকে মানুষ আসতে শুরু করেন। বিকেলে লাখ খানেক লোকের মতো হয়ে যায়। এটি কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। খেলাটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা খেলোয়াড়েরা পৃথক পৃথক দলে হাজির হন লক্ষ্মীপুর বড়ইআটা এলাকায়। পার্শ্ববর্তী উপজেলা মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও সদর থেকে সহস্র মানুষ মাঠের চারপাশে জড়ো হন। বয়স্কদের চেয়ে উঠতি বয়সের তরুণদের সমাগমই বেশি। আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় খেলা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খেলার রং বদলায়। একপর্যায়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ৪০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি। এক গুটির দখল নিতে লড়াই চলে বিভিন্ন দলের মধ্যে। খেলাটি রেফারিবিহীন চললেও কোনো হাঙ্গামা-মারামারির ঘটনা ঘটেনি। খেলার মাঠের চতুর্দিকে চলে হুল্লোড়। হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে বসেছে মেলাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের সতর্ক উপস্থিতি দেখা গেছে।
হুমগুটি খেলা দেখতে আসা লোকজন জানান, আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। নানা রকম প্রচলিত গ্রামীণ আয়োজন এখন অনেক কমে গেছে। কিন্তু এই গ্রামের প্রাচীন খেলাটি এখন আনন্দের খোরাক হয়ে টিকে আছে।
এলাকায় জনশ্রুতি আছে, মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তর সঙ্গে ত্রিশালের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের প্রজাদের মধ্যে তালুক-পরগনা জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তালুক-পরগনা সীমান্তে এ খেলার আয়োজন করা হয়। খেলার শর্ত ছিল, যেদিকে গুটি যাবে তা হবে তালুক, পরাজিত অংশের নাম হবে পরগনা। সেই থেকে প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য জমিদারদের এই পাতানো খেলা চলছে বছরের পর বছর ধরে।
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, এবার খেলার আয়োজন করতে স্থানীয় প্রশাসন নিষেধ করে। তাই উপস্থিতি আগের বছরগুলোর তুলনায় কম।
খেলা দেখতে আসা অশীতিপর আঃ মজিদ (৮০) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই এ খেলা দেখে আসছি। আগে এ খেলা একাধারে এক সপ্তাহ চলত।’