ফাইল ছবি
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী ‘মণ্ডা’ অবশেষে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল। সোমবার দুপুরে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে এ খবরটি প্রচার হওয়ার পর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে সর্বমহলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আনুমানিক ১৮২৪ সালে মুক্তাগাছার রামগোপাল পাল প্রথম এ মণ্ডা তৈরি করেন। তার প্রথম মণ্ডা তৈরি নিয়েও একটি গল্প প্রচলিত আছে। এক রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন- তার শিয়রে দাঁড়িয়ে এক সন্ন্যাসী মণ্ডা বানানোর আদেশ দিচ্ছেন। পরে স্বপ্নযোগে কয়েক রাতে সন্ন্যাসী তাকে মণ্ডা বানানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। শেষ নিয়মটি শেখানোর পর সন্ন্যাসী তাকে আশীর্বাদ করেন বলেন- ‘মণ্ডা বানানোর জন্য এক সময় তুই অনেক খ্যাতি অর্জন করবি।’ রামগোপাল পাল মণ্ডা বানিয়ে খ্যাতিমান হয়েছিলেন- সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই।
আগের দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি, বাড়ির পারিবারিক অনুষ্ঠান পূজাপার্বণ ও বিভিন্ন প্রয়োজনে মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে প্রচুর মিষ্টির প্রয়োজন হতো। ১৮২৪ সালে তৎকালীন মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর কাছে মণ্ডা বানিয়ে পেশ করেন মুক্তাগাছা থানার তারাটী গ্রামনিবাসী রামগোপাল পাল। তার স্বাদ জমিদারকে এতই মুগ্ধ করেছিল যে, সেই সময় থেকেই মণ্ডা জমিদারবাড়িতে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। জমিদারদের খুবই পছন্দের মিষ্টি ছিল এই মণ্ডা। তাদের হাত ধরে ক্রমেই উপমহাদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এ মণ্ডার খ্যাতি।
মণ্ডা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রমেন্দ্রনাথ পাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার রথীন্দ্রনাথ পাল জানান, টেলিভিশনে খবরটি দেখলাম খুব ভালো লাগছে। এই মিষ্টির প্রধান উপকরণ হিসেবে দুধের ছানা ও চিনি বা গুড় ব্যবহার করা হয়। এক কেজি মণ্ডা তৈরিতে আধা কেজি চিনি এবং ৭ কেজি দুধের প্রয়োজন পড়ে চিনি জ্বাল দিয়ে সিরা এবং ৭ কেজি দুধ জ্বালিয়ে ১ কেজি ছানা তৈরি হয়। পরে সিরা ও ছানা জ্বালিয়ে পরে এটাকে ঠাণ্ডা করা হলে তৈরি হয় মণ্ডা। স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রাখতে গিয়ে প্রতি কেজিতে লাভ হয় মাত্র ৩৫-৪০ টাকা। তবে গুণগতমান বজায় রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর এবং আপসহীন ছিলাম বলেই হয়তো দেশ তথা বিশ্বব্যাপীর সুনাম অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পরিশেষে আমরা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছি। এ অর্জন ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছার মানুষের অর্জন। মণ্ডার মান ধরে রাখতে আমরা আরও দায়িত্বশীল হব। বতর্মানে চিনির তৈরি মণ্ডা সাতশ টাকা এবং গুড়ের তৈরি মণ্ডা আটশ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বতর্মানে লাভ কম হচ্ছে তবুও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
জামালপুর থেকে মণ্ডা কিনতে আসা স্বাধীন নামের এক কলেজছাত্র যুগান্তরকে বলেন, আমি বতর্মানে ঢাকায় কোচিং করছি, মেসের বন্ধুরা মণ্ডার নাম শুনেছে; কিন্তু কখনো খায়নি তারা। তাদের জন্য মণ্ডা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এই মণ্ডা আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত বাড়িয়ে দেয়।
আরিফ নামের একজন বলেন, এতে সাধারণ পাবলিকের কোনো লাভ হলো না বরং লাভ হলো মালিকপক্ষের। এখন তাদের ডিমান্ড আরও বেড়ে যাবে- বলবে আমাদের মণ্ডা এখন জিআই পণ্য। এই অজুহাতে তারা তাদের ইচ্ছামতো দামও বাড়িয়ে দেবে।
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, অফিশিয়ালভাবে এখনো আমরা বিষয়টি জানতে পারিনি, তবে ময়মনসিংহের একটি পণ্য জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাবে সত্যিই এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়। এই স্বীকৃতি বিশ্ব দরবারে মুক্তাগাছার মণ্ডার পরিচিতি বাড়িয়ে দিবে।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মুক্তাগাছা পৌরসভা শহরে জমিদারবাড়ির কাছে পূর্বদিকে জগৎ কিশোর রোডে রামগোপাল পাল ওরফে গোপাল চন্দ্র পালের মণ্ডার দোকান। গোপাল পালের মৃত্যুর পর তার পুত্র রাধানাথ পাল, রাধানাথের পুত্র কেদারনাথ পাল, কেদারনাথের পুত্র দ্বারিকনাথ পাল এবং বর্তমানে দ্বারিকনাথের পুত্র রমেন্দ্রনাথ পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স মণ্ডার ব্যবসা চালাচ্ছেন। তারা গোপাল পাল পরিবারের পঞ্চম বংশধর। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ছাড়া দেশের আর কোথাও এ প্রতিষ্ঠানের শোরুম নেই।