শিল্পী আক্তারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা জামালপুর শহরের দেওয়ানপাড়া এলাকায়। মা-চাচীদের দেখেছেন অবসর সময়ে হাতের কাজ করতে। নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর অনেক সময় হাতের কাজের নানা জিনিসপত্র বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করেছেন। মায়ের কাছেই তার হস্তশিল্পের কাজ শেখা। এখন স্থানীয় আশেক মাহমুদ সরকারি কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি হস্তশিল্পের কাজ করেন। এতে নিজে যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি পরিবারের দুঃসময়েও পাশে দাঁড়াতে পারেন তিনি।
শিল্পীর ভাষ্য, এই শহরে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে হস্তশিল্প। অনেক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি ক্ষমতায়নও সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা।
তিনি জানালেন, হস্তশিল্পে কাজ করে মাসে যা আয় হয়, তা দিয়ে তিনি লেখাপড়া ও ব্যক্তিগত খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন। ভবিষ্যতে তিনি উদ্যোক্তা হতে চান। শুধু শিল্পীর নয়, নদীভাঙন ও দারিদ্র্যপীড়িত জামালপুর জেলায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। কাপড়ে সুচ ফুটিয়ে নিপুণ হাতে কারুকাজখচিত বাহারি পণ্য তৈরি করছেন এই জনপদের নারীরা। তাদের হাত ধরে জামালপুর এখন হস্তশিল্পের শহর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই শিল্পের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে সরকার ইতোমধ্যে জামালপুর শহরের কম্পপুর এলাকায় নির্মাণ করছে শেখ হাসিনা নকশিপল্লীর। নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, এই পল্লীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তারা, যা কুটির শিল্পে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর শহরের অলিগলিতে অনেক ঘরেই হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কাজ করে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। তারা তৈরি করছেন থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, বিছানার চাদর, কুশন কভার, শাড়ি, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, হাতপাখাসহ নানা পণ্য।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন বিদেশেও যাচ্ছে এসব পণ্য। হস্তজাত পণ্য তৈরি করে অনেক নারী জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। একই সঙ্গে শত শত নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ফলে বছরে শতাধিক কোটি টাকার হাতের তৈরি নানা জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে এই জেলা থেকে।
তবে করোনার থাবায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কাজ করে চলেছেন। নারী উদ্যোক্তা শিল্পী আক্তার বলেন, করোনায় তেমন অর্ডার আসেনি। ফলে ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে অনেকের। আবার অনেকে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইছে।
জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে এই কাজ শুরু হলেও বড় আকারে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। একসময় সম্ভাবনাময় এই শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। গ্রামাঞ্চলের নারীদের নিপুণ হাতের জাদুতে আবারও এই শিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে এই শিল্প দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়াচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী-পুরুষ এখন এই পেশায় জড়িত। আর এর ৮০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের নারী। সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তারা ঘরে বসেই হস্তশিল্প ও নকশীকাঁথার বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। বাড়তি আয়ের জন্য অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীরাও এই পেশায় আসছেন।
সম্প্রতি ঘুরে দেখা যায়, শহরের ঢাকাইপট্টি থেকে দেওয়ানপাড়া হয়ে আশেক মাহমুদ কলেজের গেট পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশে নারীদের পরিচালিত হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির কারখানা ও দোকান গড়ে উঠেছে। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় চোখে পড়ে সারি সারি হস্তশিল্পের দোকান। অনেক আবাসিক ভবনেও বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
এছাড়া আমলাপাড়া, বসাকপাড়া, কলেজ রোড, বকুলতলা, জিগাতলা, মুন্সিপাড়া, মিয়াপাড়া, বেলটিয়া, পাথালিয়া, পাঁচ রাস্তার মোড়, কাছারিপাড়াসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় হস্তশিল্পের বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে বলে জানান রেজিয়া হস্তশিল্পের স্বত্ত্বাধিকারী মোছা. হাবসা খাতুন।
জামালপুরের হস্তশিল্প ব্যবসায়ীরা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। তাদের মতো দেশের অন্যান্য এসএমই উদ্যোক্তারাও এখন স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্রের দাবি করছেন। এ বিষয়ে হাবসা খাতুন বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা নকশীপল্লী নির্মিত হলে তাদের জন্য স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠবে। এতে লাভবান হবেন উদ্যোক্তারা। তাদের ব্যবসার প্রসারও ঘটবে।
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি (নাসিব) জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি মো. শাহিনুর আলম বলেন, জেলায় প্রায় আড়াই হাজার বড় উদ্যোক্তা রয়েছেন। সব মিলিয়ে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৪ লাখের মতো নারী-পুরুষ।
‘এ শিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হতদরিদ্র নারী শ্রমিকেরা যেমন সঠিক মূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এই জেলায় গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পুরো বদলে যাবে। সামগ্রীকভাবে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে।