Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

কার্তিক ৮ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪

অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক পথেই আছে

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ১৬:২১, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

প্রিন্ট:

অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক পথেই আছে

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান সময়ে তার সামনে অগ্রাধিকার বিষয়গুলো উল্লেখ করে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেই কলামে উল্লেখযোগ্য অগ্রাধিকারের তালিকায় হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমার লেখার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হোক আর না হোক, বর্তমান গভর্নর যে এই অর্থ উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা রাখেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। এ দুজন গুণী মানুষের লেখালেখি এবং আলোচনা থেকে আমাদের অন্তত এই ধারণা হয়েছে যে বাংলাদেশে এই বিষয়ে তাদের থেকে অন্য কেউ ভালো জ্ঞান রাখে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারে সঠিক পথে আছে। 

এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। এখন বিষয়টি যাতে সফল পরিসমাপ্তির দিকে যেতে পারে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে তাদের খোয়া যাওয়া অর্থ আইনি খরচসহ ফিরে পেতে পারে, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। গভর্নর নিশ্চয়ই ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি তদারকি করছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

এত বিশ্বাস এবং আশাবাদ থাকার পরও আশাহত হতে হয় যখন আমাদের দেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হতে দেখি। ঘটনা ঘটার পর থেকে, এমনকি অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করে যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ার পরও কোনো না কোনো সংবাদপত্রে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশ মোটেই দোষের নয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন প্রতিবেদনটি অর্থ উদ্ধারের পথে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে সবসময়ই বলার চেষ্টা করা হয় ঘটনাটির জন্য শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এর কয়েকজন নির্বাহী বা কর্মকর্তা দায়ী। 

এটি যে একটি উচ্চ মাত্রার হ্যাকিং এবং এর মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক মানের মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এই মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধটি যে হয়েছে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকিং করপোরেশনে, সে বিষয়টি প্রতিবেদনে সেভাবে স্থানই পায় না। এ রকমই একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে যেখানে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন কেন জমা হয়নি। না হওয়ার পেছনে কাদের হাত রয়েছে ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এসব প্রতিবেদনের অবশ্যই প্রয়োজন আছে এবং কর্তব্যে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি প্রদানের বিষয়টিও নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধার করা। এই উদ্দেশ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা চলমান মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপক্ষে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রিজার্ভ হ্যাকিং ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন সময় প্রাসঙ্গিকতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রায় দুই ডজনেরও অধিক কলাম লিখেছি। প্রতিটি লেখায় স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছি যে আর্থিক জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত যত আইন এবং বিধিবিধান আছে, যেমন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ইউএস প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট, কেওয়াইসি (নো ইয়র কাস্টমার), গ্রাহকের লেনদেন প্রোফাইল, প্রদানকারী ব্যাংকের দায়-দায়িত্ব (পেয়িং ব্যাংকের দায়িত্ব); এর সবকিছুই অমান্য করে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংক সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই লেনদেন সম্পন্ন করেছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্ব যে আরসিবিসি ব্যাংকের তা প্রমাণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোটেই বেগ পাওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে এই মামলার পেছনে লেগে আছে এবং আগামীতেও যদি লেগে থাকে তা হলে রিজার্ভের খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পেতে মোটেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেই আছে, যা আমি রেফারেন্স হিসেবে আগেই একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি।

বিষয়টির গুরুত্বের কারণে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আবারও উল্লেখ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং হওয়ার আগে একই রকম ঘটনার শিকার হয়ে ইকুয়েডরের একটি ব্যাংক ১২ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছিল। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে সম্পূর্ণ অর্থ ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংককে ধৈর্য ধরে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মামলাটি চালিয়ে নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায় বিপক্ষে গেলে তা যে কী ভয়ংকর হতে পারে তা আমরা যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, বিশেষ করে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বিষয় নিয়ে খোঁজখবর রাখি, তারা ভালোভাবেই জানি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতে পারি কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে আছে সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বিচার বিভাগ। 

আর এ কারণেই মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে লেনদেন করতে এবং ডলারে অর্থ জমা রাখতে সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করে। নিয়মবহির্ভূত লেনদেনে জড়িত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আদালত যে কি ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারে তা ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভালোভাবেই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা আদালতের রায় যে কী মারাত্মক হতে পারে তার দৃষ্টান্ত অসংখ্য আছে। আমেরিকার মিত্র পশ্চিমা বিশে^র অনেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর শাস্তির হাত থেকে রেহাই পায়নি। সবশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমেরিকার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে মিত্র দেশ কানাডার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান টিডি ব্যাংক। মানি লন্ডারিং লেনদেনের অভিযোগ থাকায় টিডি ব্যাংক আমেরিকার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে।

আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে লাইবর ইন্টারেস্ট রেট জালিয়াতি, যা ছিল এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম আর্থিক কেলেঙ্কারি। লাইবর রেট কেলেঙ্কারির মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই রেট বন্ধ হয়ে গেছে। এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ইউরোপ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান বিষয়টি নিয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করায় এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্তের বিচার যুক্তরাজ্যের আদালতে সম্পন্ন হয়েছে। যদিও তারা এই বিচার আমেরিকার আদালতে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু যুক্তরাজ্যের আদালতের এক সিদ্ধান্তের কারণে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আদালতের এ রকম কঠোর শাস্তি দেওয়ার নজির অসংখ্য আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলার আরও একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে এখানকার আদালত শুধু বাদীর বিষয়টিই যে দেখেন, তেমন নয়। সেই সঙ্গে আদালত এটিও গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন যে মামলার কোনো পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি কি না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেমকে অপব্যবহার করছে কি না। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত আরেকটি দেশের রিজার্ভের টাকা সহজেই বের করে নিয়ে অন্য কোনো ব্যাংকে বা প্রতিষ্ঠানে লেনদেন নিষ্পত্তি করে ফেলা যায়, তা হলে সেই প্রতিষ্ঠান যে যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয় তা আদালত ভালোভাবেই বুঝতে চেষ্টা করবে। এসব বিষয় আরসিবিসি ব্যাংক এবং তাদের আইনজীবী ভালোভাবেই জানে তাদের এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। এই আত্মসাৎ করা অর্থ তাদের কাছে না থাকলেও এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকেই দিতে হবে। এটিই ক্ষতিপূরণ প্রদানের নিয়ম। এভাবেই অতীতে ইউরোপের অনেক বৃহৎ ব্যাংক শত শত বিলিয়ন ডলার জরিমানা প্রদান করেছে। সবশেষ কানাডার টিডি ব্যাংককেও ৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা এভাবেই প্রদান করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলার এখন পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। হয় সেটি আদালতের মাধ্যমে হবে বা আদালতের বাইরে বিবাদী পক্ষ আরসিবিসি ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে অর্থাৎ আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্টের মাধ্যমে হতে পারে। উল্লেখ্য, আমেরিকা-কানাডায় দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি বা আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট খুবই জনপ্রিয় একটি ব্যবস্থা। 

যেভাবেই হোক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ সম্পূর্ণরূপে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দায়ের করা মামলাটি সফলভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। অন্যদিকে তেমনি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা বা প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হেইস্ট অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়, এটি মূলত ক্রস-বর্ডার সমস্যা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন এবং যুক্তরাষ্ট্র। আরও সংশ্লিষ্ট আছে আমেরিকার ডলার এবং আমেরিকার অর্থ ব্যবস্থা বা ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম। এর প্রক্রিয়া, আইন বা বিধিবিধান লঙ্ঘনের মতো ঘটনা এবং পরিণতি বেশ জটিল।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হেইস্টের ঘটনার বিষয়ে কথা বলা, আলোচনা করা বা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারলে দেশ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer