ফাইল ছবি
নিজেকে সিঙ্গাপুরের নাগরিক দাবি করে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মো. সাইফুল আলম আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ চুক্তির আলোকে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের আইনি সুরক্ষা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি হয়েছে ২০০৪ সালে। সেই চুক্তির আলোকেই এই নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল মঙ্গলবার কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে।
একই বিষয়ে যুক্তরাজ্যের দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসও একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে ‘ভীতি প্রদর্শনমূলক ব্যবস্থা’ নিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে ও তার সুরক্ষা প্রাপ্য বলে মনে করেন সাইফুল আলম। তা না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশি মামলাও করতে পারে এস আলম গ্রুপ।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, গভর্নর আহসান মনসুর এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনসমক্ষে ভিত্তিহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তার এ বক্তব্য এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘ভীতি প্রদর্শনমূলক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এস আলম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভুল ও মানহানিকর। বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু আন্তর্জাতিক সালিশি মামলা নয়, প্রয়োজনে অন্যান্য ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তির অধীন বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের মন্তব্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মন্তব্য হিসেবে গণ্য হবে। আরও বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের বিদেশি বেসরকারি আইন অনুসারে সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে এস আলম ও তার পরিবারের অধিকার ও সুরক্ষা আছে।
এর আগে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এস আলম গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে সরকার প্রধানের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। এর মধ্যে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম একাই ১ হাজার কোটি ডলার দেশের বাইরে পাচার করে নিয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ব্যাংক ডাকাতির এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। ওই সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে এস আলম পরিবারের পক্ষে এই চিঠি দিয়েছে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েল উর্কুহার্ট অ্যান্ড সালিভান।
এ অভিযোগ প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, তার দাবির শতভাগ ভিত্তি আছে। বিভিন্ন ব্যাংকে অনেক বছর ধরে এসব দুর্নীতি হয়েছে। এসব তথ্য প্রমাণ সংকলন করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ সংকলন করতে সময় লাগবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই কাজ করছে।
জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের আইন অনুযায়ী, ২৫ লাখ সিঙ্গাপুর ডলার (প্রায় ২৩ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেই সে দেশের নাগরিক হওয়া যায়। এ জন্য তার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। পাশাপাশি সেই দেশে আরও বিনিয়োগ করতে হয়। এটা করতে পারলে তাদের সন্তানরা সে দেশে সরকারি চাকরির সুযোগও পান। সিঙ্গাপুরের নাগরিক নিতে হলে নিজ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হয়। তাই ব্যাংক থেকে লাখো কোটি টাকা লোপাটের পর সপরিবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন এস আলম। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রত্যাহার করেন এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তাদের তিন ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির। একই দিন বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের (পারমানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল) অনুমোদন পায় পরিবারটি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এসব সুবিধা দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অর্থ পাচারের পথ সহজ করা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জবাবদিহি এড়াতে এমন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিয়ে গেলেও স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেতে এস আলম পরিবারের সদস্যরা জনপ্রতি বিনিয়োগ দেখিয়েছেন মাত্র ৭৫ হাজার ডলার।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আইন মেনে বিদেশে বিনিয়োগের কোনো অনুমোদন সাইফুল আলম নেননি। দেশের যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বৈধভাবে বিনিয়োগ করেছে, সেই তালিকায় সাইফুল আলমের নাম নেই।