সাধারণত: খাসি ও জৈন্তা পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীরা খাসি নামে পরিচিত। তারা দৈহিক আকৃতির দিক থেকে মন্দোলয়েড, মাতৃসূত্রীয় সম্পতির উত্তরাধিকারী এবং ঊনিশ শতক পরবর্তী সময়ে প্রধানত: খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারী। ভৌগোলিক, অবস্থানগত ও ভাষারীতির প্রেক্ষিতে সকল খাসি জনগোষ্ঠীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।
এক. খিনরিয়াম-মধ্য খাসিপাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী। দুই. নার (চহধৎ) - জৈন্তা পাহাড় ও জৈন্তাপুরে বসবাসকারী। তিন. ওয়ার, সিলেট সমতল ও সিলেটের কাছাকাছি পাহাড়ের ঢালুতে বসবাসকারী। চার. ঋয়-আসামের কাছাকাছি উত্তর খাসি পাহাড়ে বসবাসকারী। পাঁচ. লিনগাম পশ্চিম খাসি পাহাড়ে বসবাসকারী। (ফায়েল ১৯৯৫)
বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ খাসি জনগোষ্ঠী তাই ‘নার’ ও ‘ওয়ার’ খাসি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। খাসিদের বর্তমান মোট জনসংখ্যার কোন সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান নেই। খাসি জনগোষ্ঠীদের দু’এক জন নেত্রীস্থানীয় প্রতিনিধির মতে বর্তমানে দেশে প্রায় ২০,০০০ খাসি বসবাস করে।
১৯৯১ সালে জনসংখ্যা জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশে খাসিদের মোট সংখ্যা ছিল ১২,২৮০ জন। ১৯৬১ সালে আদমশুমারীতে পূর্ব পাকিস্তানে খাসি জনসংখ্যা ছিল ৮০,০০০। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে কিছু খাসি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেছে। যেখানে তাদের সামাজিক ও ভাষাগত প্রভাব অধিক। ধারণা করা হয় বাংলাদেশে ৯০টি খাসী গ্রাম রয়েছে যারা মূলত সিলেট ও মৌলভীবাজারে অবস্থিত এবং প্রতিটি গ্রামে তাদের ভূমির পরিমান ৫০-২৫০ হেক্টর। এ সকল গ্রামগুলোকে তারা বলে থাকে ‘পুঞ্জি’। প্রতিটি পুঞ্জিতেই একজন করে হেডম্যান রয়েছে।
খাসিদের সিলেট আবাসন
সিলেটে খাসিদের আবাসন সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে ষোড়শ শতাব্দিতে তারা স্বাধীন জৈন্তা রাজ্য নামে একটি অঞ্চল গড়ে তোলে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতে আজ হতে ৫০০ বছর পূর্বে সিলেটে খাসিদের বসবাস শুরু হয় (রহমান ২০০৯)। গোস্তারের মতে আসামের এক ভয়ংকর বন্যা খাসিদেরকে উদ্বাস্তু করে তোলে এবং তারা ক্রমে সিলেট আশ্রয় লাভ করে।
নাইয়ান এর মতে, মুতদা ছিল খিংচেষ্ট রাজবংশের আদি পীঠস্থান। ১৪শ শতকের শেষের দিকে এই রাজবংশের রাজা পর্বত রায় সিলেট সংলগ্ন সমতল ভূমি জয়ন্তিয়া পরগনা দখল করেন এবং তারই অধ:স্তন এক রাজা বড় গোসাইন রাজধানী সুন্তুদা (নরতিয়াং) হতে জয়ন্তাপুরে স্থানান্তরিত করেন। সেই সুবাদে কালক্রমে জয়ন্তিয়া নামে তাদের উপর আরোপিত হতে পারে।’
ভারতে খাসিয়াদের আদি নিবাস সংক্রান্ত জনশ্রুতি জানা যায়, ‘প্রথমে ঈশ্বর ষোলটি পরিবার সৃষ্টি করলেন। তাঁর সন্ধ তারা স্বর্গেই বসবাস করত। তখন পৃথিবীর কেন্দ্রে ‘সুজেটবেলেং’ নামক একটি পাহাড় ছিল। এটি ছিল স্বর্গীয় নাভী। এই নাভি থেকে একটি কৃষ্ণ জন্ম লাভ করে, যে বৃক্ষটি চেয়ে ষোলটি পরিবার স্বর্গমর্ত্যে যাতায়াত করতো। গাছটি স্বর্গ ও মত্যৈর মধ্যে এবং ঈশ্বও ও মানুষের মাঝে এক সোনালী সিঁড়ি হয়ে কাছ করে।
একদিন সাতজন মহিলা এই সিড়ি বেয়ে পৃথিবীতে আসেন, তখনই একটি অশুভ শক্তি ঐ গাছটি কেটে ফেলে। ফলে ঐ সাজ মহিলা আর কিছুতেই স্বর্গে যেতে সক্ষম হলেন না এবং মতৈৗই থেকে গেলেন। বাকি নয়জন স্বর্গে রয়ে গেলেন। এই সাতজন মহিলাই মানব জাতির সাত মাতা হয়ে থাকলেন। তারা শিলং পাহাড়ের চুড়ায় বাস করতে লাগলেন এবং ঈশ্বরের সাথে তাদের প্রত্যেক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন হল। ঈশ্বর তাদের মত্যৈ থাকার অনুমতি দিলেন এবং বললেন তারা নয়টি পরিবারের সাথে স্বর্গে মিলিত হতে পারেন যদি তারা তিনটি সূত্র নিষ্টার সাথে পালন ।
এই তিনটি সূত্রই খাসি জয়ন্তিয়া ধর্ম সূত্র: এক. নৃবিজ্ঞান অর্জন করা। দুই. ঈশ্বর ও মানবকে জানা। তিন. কুল বা বংশনীতি ও কুলতোন অর্জন করা। কেউ কেউ এই লোকগুলোকে অনুসরন করে খাসিদের আদি নিবাস ভারতের শিলং পাহাড় বলে সনাক্ত করেন যদির এর কোন ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি খুজে পাওয়া দুষ্কর। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘঁনাপুঞ্জি : আসাম, মেঘালয় ও সিলেট, ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলে খাসিদের ভূ-রাজনৈতিক পটভুমি পরিবর্তনের ফলে এসব অঞ্চলে খাসি আধিপত্য না থাকলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রাচীনকালে আসামের খাসিদের মালনিয়াং রাজ্য ও হাদেম রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। মেঘালয়ের পূর্বাঞ্চল আদিকাল হতে অদ্যাবধি খাসিদের আধিপত্য বিরাজ করছে।
খাসি লেখক শিবচারণ রায়-এর মতে, প্রাচীনকালে সারা খাসি অঞ্চলে একজন মাত্র রাজা ছিলেন। তিনি মাঠুর মাস্কুট নামক স্থানে বসে তার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। মাধুর মাস্কুট স্থানটি সিলেটের জাফলং নামক স্থানে অবস্থিত। পূর্বে সুদূর মণিপুর হতে এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ পর্যন্ত উত্তরে ব্রাহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত এবং দক্ষিণে কুশিয়ারা ঢাকা পর্যন্ত তার শাসনভাগ ছিল। তার অধীনে ৪ জন খাসি রাজা ছিলেন, ১. সিলেটের জৈন্তিয়া রাজা ২. খাসি পাহাড়ের মাওরোহ ৩. খাসি পাহাড়ের ইয়ং রাজা এবং ৪. ময়মনসিংহ সুনামগঞ্জের লাইড় গুনানতি এবং পরবর্তীতে সমং রাজা। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার শাসনের কার্যকারিতা ছিল। পরবর্তীতে জৈন্তিয়া রাজা তাকে ছলে বলে কৌশলে পরাজিত করে তার রাজ্য ধ্বংস করে দেয় এবং খাসিদের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের সূত্রপাত ঘটে।
সিলেট অঞ্চলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৭৬৫ সাল হতে খাসিরা খণ্ড খণ্ড আক্রমণ শুরু করে এবং একাধিকবার সিলেট শহর তছনছ করে। ১৮৩৫ সালে খাসিদের জৈন্তিয়া রাজ্য ব্রিটিশ অধিকারে আসে। জৈন্তিয়া রাজ্য রাজ্যেন্দ্র সিংহ ১৮৬১ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে মারা যান। খাসিদের অন্যতম বিদ্রোহী নেতা উকিয়াং নাংবাহকে ১৮৬২ সালে ৩০শে ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় ব্রিটিশরা। খাসিদের অন্যতম বিদ্রোহী রাজা কিরত সিংহ ১৮৫৭ সালে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে খাসিদের অবদান নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। লোকমুখে জানা যায় যে, খাসিরা সীমান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ও খবরাখবর আদান প্রদানে সাহায্য সহযোগিতা করতো। ইয়নিস খাসির মতো অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কাকন বিবি নামে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত নাম কাকেউ নিয়তা। সুনামগঞ্জের নওত্রই নামক গ্রামে মার্তৃসূত্রীয় খাসি পরিবারের জন্ম এই মহিয়সী নারীর। মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের দোয়ারা বাজারের কাকেট নামে মহিলার অবদান স্থান পেয়েছে কিছু পুস্তকে।
লেখক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বহুমাত্রিক.কম-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য
বহুমাত্রিক.কম