ছবি: বহুমাত্রিক.কম
সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-এ অবস্থিত এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ- এর কৃষি অনুষদের একদল গবেষক চাঁপাইনবাবগঞ্জে বসবাসরত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানের উপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। ১২০ জন সাঁওতালের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। কৃষি অনুষদের অধীনে ৪ জন শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই গবেষণা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষক মিঠুন কুমার ঘোষ।
শিক্ষার্থীরা হলেন উম্মে মুসারাত মিশু, আফরোজা আওয়াল শৈলী, শফীকুল ইসলাম এবং আফরোজা খাতুন। উল্লেখ্য, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর উপাচার্য প্রফেসর ড. এবিএম রাশেদুল হাসান এই গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি জনগোষ্ঠী হল সাঁওতাল। দেশের উত্তরাঞ্চল যেমন- দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তাদের বসবাস। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল, তথা- দেলবাড়িয়া, বালিয়াড়াঙ্গা (সাঁওতাল পাড়া), বাবুডাইং, হোসেনডাইং, জলাহার (আমনুরা) অঞ্চলে তাদের বসবাস পরিলক্ষিত হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সাঁওতালরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এদের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। তারা কঠোর পরিশ্রমী এবং কর্মঠ প্রকৃতির। তবুও তাদের চাষাবাদ পদ্ধতি ও কৃষি বিষয়ক বৈজ্ঞানিক ধারনা এখনও অনুন্নত ও অপরিমিত। কৃষি কাজের পাশাপাশি তারা যেসব কাজে নিয়োজিত থাকে তা হল শিক্ষকতা, সেবিকা, দিনমজুর, মাছচাষ, রাজমিস্ত্রী, ভ্যানচালক, গবাদি পশুপালন ও হাঁস-মুরগী পালন, কুঁচিয়া চাষ ইত্যাদি। দিনমজুর হিসেবে পুরুষরা দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা এবং মহিলারা ২৫০-৩০০ টাকা পেয়ে থাকে। অধিকাংশ সাঁওতালদের নিজস্ব কোন জমি নেই। তারা বেশির ভাগ-ই বর্গাচাষী। কিছু সাঁওতালদের নিজস্ব জমি থাকলেও দরিদ্রতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মহাজন কর্তৃক শোষণ ইত্যাদি কারণে তারা ভূমিহীন। জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু হওয়ায় জমি দখলের অভিযোগও পাওয়া যায়।
সাঁওতালরা পুরুষ প্রধান পরিবার হলেও মহিলাদের কর্তৃত্ব একেবারে তুচ্ছ নয়। তারা সংসার চালানোর পাশাপাশি আয় রোজগার এবং কৃষি কাজে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। একক পরিবারেই তাদের বসবাস বেশি লক্ষ্য করা যায়। মা, বাবা এবং অবিবাহিত সন্তান নিয়ে তৈরী হয় একক পরিবার। যৌথ পরিবারে থাকে বাব-মা, ভাই-বোন, ননদ, শ্বশুর-শাশুড়ি ও অন্যান্য সদস্য।
ভূমিহীন সাঁওতালরা খাস জমিতে বসবাস করে। কিছু সংখ্যক সাঁওতালদের নিজস্ব বাড়ি আছে। প্রায় সব বাড়ি মাটির তৈরী। বাড়ির বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন রকমের নকশা দেখা যায়, যা বেশ আকর্ষনীয় ও মনোরম। বাড়ির আশেপাশে শোভা বর্ধণকারী উদ্ভিদ লক্ষ্য করা যায়। জাতিগতভাবে সাঁওতালরা সনাতন ধর্মালম্বী হলেও কিছু সাঁওতাল পৈতৃক সূত্রে নিজেদের খ্রিস্টান দাবি করেন। সাঁওতালদের পদবী গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কোল, টুডু, মুরসু, হসদা, হেব্রম, বাসকি ইত্যাদি।
সাধারণত এখানকার সাঁওতালরা দুটি ভাষায় কথা বলে থাকেন, বাংলা এবং সাঁওতালি। বাংলা তাদের নিজস্ব ভাষা না হলেও পাঠ্য ভাষা হিসেবে এ ভাষা জানতে হয়। অন্যথায় তারা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে থাকে। সাঁওতালদের পোশাক সাধারন বাঙ্গালীদের মতই। মহিলারা শাড়ি এবং পুরুষরা লুঙ্গি পরে। সাঁওতালরা চিকিৎসার জন্য গ্রাম্য ডাক্তারদের সাহায্য নেয়। বিশুদ্ধ পানির জন্য তারা টিউবওয়েল ব্যবহার করে থাকে। কিছু এলাকায় এর ব্যবস্থা না থাকায় দূরে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়।
সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম। তারা অধিকাংশই অশিক্ষিত। কিছু সাঁওতাল মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও প্রায় সবাই প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। পড়াশোনা না করতে পারার জন্য তারা তাদের দরিদ্রতাকে দায়ী করে থাকে। পাশাপাশি বাবা-মার উৎসাহ না পাওয়া এবং আশেপাশে কোন স্কুল কলেজ না থাকাকেও দায়ী করে। তারা জানায়, কাছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় তাদের ছেলে মেয়েরা এখনও উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর্থিক সমস্যাকে দায়ী করে তারা জানায়, দূরের পথ পাড়ি দিয়ে ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করানো তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য এবং দূরুহ। আবার খুবই সীমিত সংখ্যক সাঁওতালকে স্নাতক পর্যন্ত পড়ালেখা করতে দেখা যায়।
বর্তমান প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, কিছ সংখ্যক সাঁওতাল বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এর সাথে জড়িত আছে, যা তাদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও, তারা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে আসছে।
সরকারের ‘একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প’ এর মাধ্যমে তারা অনেক সহযোগিতা গ্রহন করেছে। এছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংক এর সহায়তায় বসতবাড়িসহ, পুকুরে মাছ চাষের সুবিধা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। এদের পাশাপাশি, প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি (একটি স্থানীয় এনজিও) তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে, যেমন কুঁচিয়া চাষ, বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। স্থানীয় কিছু সাঁওতালদের অভিযোগ তাদের জন্য ঋণ বা প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নাই। কিছু সংখ্যক সাঁওতাল ঋণ পেলেও অধিকাংশরাই বঞ্চিত। বয়স্ক ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তারা পায় না। ফলে তারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এবং অনগ্রসর। তারা জানায় তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য আরও অধিক পরিমানে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক: প্রভাষক, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
বহুমাত্রিক.কম