
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিই মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ফলে তার চিন্তা ও গণমুখী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ নান্দনিক বহির্প্রকাশ সম্ভবত ঘটেছে এই ঐতিহাসিক ভাষণটিতেই। পৃথিবীর ইতিহাসের বহু বিখ্যাত ভাষণের সন্ধান আমরা পাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নানা কারণেই অনন্য। শুধু একটি জাতিকে চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য নয়, এর কাব্যময়তা, এর ভাষাভঙ্গি, কণ্ঠের ওঠানামা, অঙ্গুলি হেলন, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ঘাড় ফিরিয়ে জনতার দিকে ফিরে ফিরে তাকানো, তার হুঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে জনতার গর্জন, সমুদ্রে ঝড় ওঠার মতো ধীরে ধীরে মুক্তির অভিমুখী একটি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া- সবকিছু মিলিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ একটি মহাকাব্যিক রূপ নিয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু হয়েছেন রাজনীতির অমর কবি।
তার হাতে কি ছিল জাদুর বাঁশি? তিনি কি ছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা! তার কথাতেই কি বেজে উঠত কোনো মোহনীয় সুর! তিনি যখন দরাজস্বরে বলে উঠলেন, ‘ভায়েরা আমার’, পুরো রেসকোর্স ময়দান এমনভাবে কেঁপে উঠেছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে! যখন তিনি সিংহের মতো গর্জন করে উঠে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, দশ লাখ মানুষ পরিণত হলো ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বিপুল সমুদ্রে! তার ঢেউ আছড়ে পড়ে সারা বাংলায়, প্রতিটি ঘরে। প্রতিটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মন্ত্রমুগ্ধ শিশু-কিশোর-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবী, গৃহিণী আর বেদেনী। সবাই তখন এক কাতারে দাঁড়ায়। সমগ্র জনতা রূপান্তরিত হয় প্রতিরোধের শক্তিতে। বাংলার প্রতিটি সাধারণ মানুষ তখন একেকজন সৈনিক।
বাংলাদেশের কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে মহাকবি এবং তার ৭ মার্চের ভাষণকে মহাকাব্য আখ্যা দেন। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় ওই ঐতিহাসিক ভাষণটি কী করে বাঙালির বহু বছরের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছিল তা তুল ধরেছেন এভাবে-
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি এমন একটি আলাদা মাত্রা পেয়েছে যে, ধরতে গেলে তার পুরো রাজনৈতিক জীবন একদিকে আর এই ভাষণটির মর্যাদা আরেকদিকে। এর কারণ হয়তো এই, এ ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্নিং পয়েন্ট। অনেকে এই ভাষণটিকেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে দাবি করেন। বাস্তবেও এটি ছিল মুক্তিকামী মানুষের চিরকালীন নির্দেশনা।
এই ভাষণ নিয়ে ‘রাজনীতির মহাকাব্য’ শিরোনামে একটি অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। দেশের বরেণ্য ২৬ জন ব্যক্তি সেখানে ৭ মার্চের ভাষণের বহুমাত্রিক মূল্যায়ন তুলে ধরেন। আমার সৌভাগ্য সেখানে আমারও একটি লেখা আছে। বইটির মুখবন্ধ রচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মুখবন্ধে লেখেন, ‘আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। এ ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় ছিনিয়ে আনতে। ... বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এ ঐতিহাসিক ভাষণ, যার আবেদন আজও অম্লান। প্রতিনিয়ত এ ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে।’
ওই গ্রন্থে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম বহু বছর ধরে নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে নবোদ্যমে জাগিয়ে তোলার পেছনে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভূমিকাটি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘মহাকাল ধারণ করে আছে এমন কিছু মন্ত্র- উচ্চারণ, সেগুলো কখনো নিঃশেষে পুরনো হয়ে যায় না, কখনো ধার হারায় না। তবে বাস্তবতার প্রাত্যাহিকতার অনিবার্য চাপে আমরা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হই এবং তাৎক্ষণিকতার দাবি মেটানোর তাগিদে আমরা সব সময় ব্যস্ত থাকি। তথাপি শাশ্বত সত্য হলো, মানবপ্রাণের উদগাতা সব প্রেরণামন্ত্র শেষ পর্যন্ত কিন্তু মার খায় না এবং সাধারণ মানুষের দিনাতিপাতের কোনো গভীর ফল্গুধারায় সতত বহমান থাকে। তার পর এক সময় কোনো উপলক্ষের অবলম্বনে উচ্চকণ্ঠে ডাক আসে। ... বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত উজ্জ্বল ও দিকনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত ৭ মার্চ এক উল্লেখযোগ্য বাঁক, যে বাঁক আমাদের দিয়েছে স্বাধীন এ দেশ।’
এই ভাষণে বাংলাদেশের মানুষকে শোষণ আর অপশাসনের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের সময়ে পশ্চিমা এলিটদের দ্বারা পদে পদে এ দেশের মানুষের বঞ্চনার প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরেছেন। মাত্র একটি ভাষণের পরিসরে এ কাজটি করতে তাকে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হয়েছে। প্রবল জনসংশ্লিষ্টতার জোরেই তিনি তা পেরেছেন- সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওই প্রকাশনায় ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন- “তার দেওয়া ১৯ মিনিটের ভাষণে ‘২৩ বছরের ইতিহাস’ কথাটি দুবার এসেছে। তিনি তার মূল বক্তব্যে পৌঁছার আগে বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতার পটভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং ওই বাক্যটি উচ্চারণের পর তা বিস্তৃতও করেছেন। ... ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে বাঙালি শহীদদের রক্তে। উল্লিখিত ঘটনাগুলোতে প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জুলুম চালানো হয়েছে। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বরং ১৯৫৪-৫৬ সালের মতো ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাঙালি আর পিছু হটতে রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’।”
তবে কেবল তত্ত্ব আর তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হলে এ ভাষণ বাঙালির মনে-মননে এমন আলোড়ন তুলতে পারত না। তথ্যভারাক্রান্ত লেকচার হলে এ ভাষণ বিশ্ব সংস্কৃতির অংশও হয়ে উঠত না। অল্প কথায় মানুষকে আলোড়িত করার যে অসাধারণ দক্ষতা বঙ্গবন্ধুর ছিল তার জোরেই এ ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল লিখেছেন, আগেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের যে প্রকাশনাটির কথা বলেছি সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘এই ভাষণটি সত্যিকারভাবে অনুভব করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনতে হবে; তার কথা বলার ভঙ্গিটি নিজের চোখে দেখতে হবে; তার আবেগ, ক্রোধ, ক্ষোভ এবং বেদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ভাষণের মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ সম্পর্কে জানতে হবে, পাকিস্তানি মিলিটারি-সৃষ্ট ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক বিভীষিকার পরিবেশটি বুঝতে হবে। কেউ যদি এই পুরো বিষয়টি অনুভব করতে পারেন তা হলে ৭ মার্চের ভাষণটি নিশ্চিতভাবে তার ভেতরে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে নতুন এক উপলব্ধির জন্ম দেবে।’
এ ভাষণ কত সময় ধরে বেজেছে তা আমরা জানি না। কতবার বেজেছে তাও আমরা জানি না। তবে আমরা জানি যতকাল বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, যতদিন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ওপর নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনা থাকবে- ততদিন এ ভাষণ বেজেই যাবে। এ ভাষণ বাঙালির তথা মুক্তিকামী মানুষের প্রাণের কবিতা। এই ভাষণ নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক, এ আলোচনা কখনো শেষ হবে না। বহু জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিত মানুষ, কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধজীবী, সাংবাদিক-শিক্ষক এ ভাষণটির নতুন নতুন দিক উন্মোচন করছেন প্রতিদিন। আগামী দিনের মানুষ নিশ্চয়ই আরও অনেক অজানা দিক আবিষ্কার করবে এ ভাষণ থেকে। চিরদিনের মুক্তির নির্দেশনার আরেক নাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই ভাষণ অমরই থাকবে।
ড. আতিউর রহমান : খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ-গবেষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর