
ছবি: বহুমাত্রিক.কম
সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় বাকৃবির ল্যাবে প্রস্তুত সম্পূরক খাদ্য ব্যবহার করে নতুন পদ্ধতিতে ভেটকি চাষে সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকরা। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে দ্বিগুণ লাভ হয় এবং প্রোটিনের পরিমাণও বেশি। গবেষকদের দাবি, এই পদ্ধতি সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান তৈরীর মাধ্যমে ভাগ্য বদলে দিবে।
সকাল থেকেই ময়মনসিংহের মাছের আড়তে একটি মাছকে কেন্দ্র করে হাকডাকে বেশ সরগরম। ধূসর আঁশ, রঙিন চোখ ও লম্বাটে গড়নের এই সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছটির নাম ভেটকি বা কোরাল। এই মাছের উচ্চমূল্যের কারণ সম্পর্কে এক বিক্রেতা জানান, নদীর নাব্যতা হ্রাস, দূষণ, কারেন্ট জালে পোনা নিধন এবং নদীর মোহনার প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে ভেটকির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে এর দামও বেড়েছে।
সম্প্রতি বাকৃবি'র এই গবেষণার প্রধান গবেষক ছিলেন বাকৃবির ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান এবং সহযোগী গবেষক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জাবেদ হাসান। দেশের উপকূলীয় তিনটি অঞ্চলে (সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ, কক্সবাজারের মহেশখালী এবং ভোলার চর কুকরি-মুকরি) এই গবেষণার মাঠপর্যায়ের কাজ হয়।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে, সাসটেইনেবল কোস্টাল মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের (এসসিএমএফপি) আওতায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
এ পদ্ধতিতে খাঁচায় আবদ্ধ মাছকে ধীরে ধীরে সম্পূরক খাদ্যে অভ্যস্ত করা হয়। রোগবালাই নেই বললেই চলে । নদীতে পানিপ্রবাহ থাকার ফলে মাছের বিপাকীয় বর্জ্য ও অতিরিক্ত খাদ্য মাছের ক্ষতি করে না। বরং তা নদীতে শৈবালের পরিমাণ বাড়ায় এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যও উন্নত হয়।
ভেটকি বা কোরাল মাছ Centropomidae পরিবারের অন্তর্গত, যা মিঠা ও লবণাক্ত পানির দ্রুত বর্ধনশীল মাংসাশী মাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Lates calcarifer। এই মাছ জীবন চক্রের কিশোর পর্যায়ে মিঠা পানিতে বাস করে এবং পরবর্তীতে যৌন পরিপক্ব ও প্রজননের জন্য সমুদ্রে চলে যায়। তাই উভয় পরিবেশে এই মাছ চাষ করা সম্ভব। এই মাছের দেহে উচ্চ মানের আমিষ, ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিড থাকায় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায় ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও এতে ভিটামিন এ, বি এবং ক্যালসিয়ামসহ নানান ধরনের মিনারেল রয়েছে। যা দৈনিক গঠনের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী।
অধ্যাপক শাহজাহান জানান, ভাসমান খাঁচায় ভেটকি চাষের ফলাফল জানার জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছে। একটি হলো হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনাকে বাণিজ্যিক সম্পূরক খাদ্য খাওয়ানো, অপরটি হলো নদী থেকে সংগৃহীত পোনাকে বাকৃবির ল্যাবে প্রস্তুত খাদ্য খাওয়ানো। উভয় ক্ষেত্রেই ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে। তবে বাকৃবি ল্যাব-উৎপাদিত খাদ্যে ফলাফল তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল এবং খরচও কম ছিল। এক বছর শেষে প্রতিটি মাছের গড় ওজন ছিল ১ কেজি।
চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক শাহজাহান জানান, প্রথমে নদীর উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে ৬ দশমিক ৭ মিটার ব্যাসের তিনটি বৃত্তাকার খাঁচা তৈরি করা হয়, যার প্রতিটির ধারণক্ষমতা ৬০ ঘনমিটার। দুটি খাঁচায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ২ হাজার পোনা এবং একটিতে নদী থেকে সংগৃহীত ১ হাজার পোনা ছাড়া হয়। বাণিজ্যিক পোনাগুলোকে বাজারজাত ফিডে (৫২ থেকে ৪০ শতাংশ প্রোটিন) খাওয়ানো হয়। এতে প্রতি ঘনমিটারে ১৩ থেকে ১৪ কেজি উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, নদী থেকে সংগৃহীত পোনাগুলোকে ধীরে ধীরে বাকৃবির ৩৭% প্রোটিনযুক্ত ফিডে অভ্যস্ত করা হয়। প্রতি ঘনমিটারে উৎপাদন হয় ১৭ দশমিক ৫ কেজি । ফলে প্রতি খাঁচা থেকে ১ হাজার ৫০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়। অথচ পুকুরে চাষে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ। পাশাপাশি, খাঁচায় চাষকৃত মাছের দেহে প্রোটিনের পরিমাণ ১৯ শতাংশ অন্যদিকে পুকুরে ১৭ শতাংশ।
সম্পূরক খাদ্যে অভ্যস্ত করার পদ্ধতি সর্ম্পকে অধ্যাপক শাহজাহান আরো জানান, প্রথম তিন মাস তেলাপিয়া মাছকে ভেটকি মাছের মুখের আকারের সমান কুচিকুচি করে কেটে সরবরাহ করা হয়। পরবর্তী তিনমাস কাটা তেলাপিয়া ও বানিজ্যিক কৃত্রিম ফিড সমান অনুপাতে মিশ্রিত করে সরবরাহ করা হয়। শেষের তিনমাস বাকৃবির ল্যাবে উৎপাদিত খাদ্য সরবরাহ করা হয়। দেখে গেছে উভয় ক্ষেত্রে মাছের দৈনিক বৃদ্ধি হার সমান। এছাড়াও আমাদের উৎপাদিত খাদ্যের বাজারমূল্যও অনেক কম। তাই লাভের পরিমাণ বেশি ছিল।
এই মাছ চাষের সীমাবদ্ধতা সর্ম্পকে অধ্যাপক ড মো শাহজাহান আরো জানান, জেলের সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে এর পোনা জালে ধরা পরে। তা সংগ্রহ করে তারা ভাসমান খাচায় চাষ করতে পারে। তবে তাদের আকার সমান হতে হবে। যাতে একে অপরকে খেয়ে না ফেলে। আশার কথা সম্প্রতি কক্সবাজারের গ্রীনহাউস মেরিকালচারে প্রথমবারের মতো এই মাছের পোনা বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। অন্যদিকে প্লাস্টিক ব্যবহার করে টেকসই খাঁচা তৈরী প্রথম দিকে কিছু অর্থ খরচ হলেও তা দশ পর্যন্ত টিকবে। তবে চাষীরা ইচ্ছে বাঁশ বা বেত ব্যবহার করেও কম খরচে খাঁচা তৈরী করতে পারে।
জাবেদ হাসান জানান, গত ৩০ বছরে আমাদের দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৬ গুণ এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অ্যাকুয়াকালচার সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তবে প্রাকৃতিক উৎস (নদ নদী) ব্যবহার করে মাছ চাষে কোন উন্নতি নেই। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে অনেক এ)গিয়ে গেছে। এর মধ্যে চীন সবচেয়ে এগিয়ে। তাই আমিষের চাহিদা পূরণ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এসব আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি।