ছবি: বহুমাত্রিক.কম
ইনস্টিটিউট অব স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, কলকাতার পরিচালক অরিন্দম মুখার্জী। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি, কুটনীতি ও সাংস্কৃতিক পরম্পরার নানা দিক নিয়ে কাজ করেন। ‘শরণার্থী সংকট’ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার তিনি এসেছিলেন বহুমাত্রিক.কম কার্যালয়ে। এসময় শ্রী মুখার্জী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বহুমাত্রিক.কম-এর প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে।
প্রকাশিত হচ্ছে আলাপচারিতার চুম্বকাংশ-
বহুমাত্রিক.কম : মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান মিত্র ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের যে পরম্পরা সমকালীন প্রেক্ষাপটে তার গুরুত্বকে আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন-
অরিন্দম মুখার্জী: ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশও তাই। একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হতে পারে; তার থেকে অনেক কাছাকাছি আসা সম্ভব যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়। সেই বিচারে এবং সমকালীন প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ-ভারেতর পারস্পারিক সম্পর্ক এখন আরও বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। সেটি সরকারি স্তরে এবং জনগণের স্তরেও। ...বাংলাদেশের কিছু অভাব থাকতে পারে, আমরা সেটা পূরণ করতে পারি। আমাদের দিক থেকেও কিছু অভাব থাকতে পারে, সেটা বাংলাদেশ পূরণ করতে পারে। বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরবর্তী বিশ্বে এই ধরণের কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা যদি দুই দেশ হাতে হাত মিলিয়ে চলি, আমার মনে হয় এই অঞ্চলের শান্তি যেমন থাকবে তেমনি বৈশ্বিক ভাবেও আমরা অনেক সমস্যা একসঙ্গে মোকাবেলা করতে পারব।
বহুমাত্রিক.কম: এই অঞ্চলের কিছু সংকট সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, বাংলাদেশে যেমন রোহিঙ্গা সংকট, ভারতের মণিপুরের সাম্প্রতিক সংকট। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও ভারতের চিরকালীন বন্ধুত্বের সম্পর্কে আরও কোন কোন জায়গায় সুসংহত করার সুযোগ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
অরিন্দম মুখার্জী: আমার মনে হয়, এভাবে সংকট এতো বড় আকার নিতো না যদি তৃতীয় শক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা না থাকতো। এটা আমােদের কাছে পরিষ্কার। তারা কোনভাবেই চায় না- এই অঞ্চল স্থিতিশীল অবস্থায় থাকুক। অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করাই তাদের ভূমিকা। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার মতো ব্যাপার...যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে, যদি সুষ্ঠুভাবে কোন দেশ চলে তাদের পক্ষে (তৃতীয় শক্তি) কাজ করা অসম্ভব হয়ে যায়। আজকে যেধরণের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, এটা আমাদের মতো দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পারস্পারিক সহযোগিতায় এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ভীষণভাবে সাহায্য করবে। এই সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ট ও ঘনীভূত হওয়া উচিত।
বহুমাত্রিক.কম: আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, সেটা মুখ্যত বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই। দুই দেশের গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে এসেছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আপনি কি মনে করেন-
অরিন্দম মুখার্জী: দুই দেশেই (বাংলাদেশ ও ভারত) বর্তমানে গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। আমরা চাইব যে দু’দেশে আবার গণতান্ত্রিক সরকার আসুক। এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ঐতিহ্য হাজার বছরের। বাংলাদেশও তো একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের অংশই ছিল। বাংলাদেশেরও গণতান্ত্রিক পরম্পরা রয়েছে। মাঝখানে হয়তো কিছুদিন এই পরম্পরা চ্যুত হয়ে গিয়েছিল-মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি যখন বাংলাদেশে ছিল। নিশ্চিতভাবেই আমরা যদি পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারি-আমরা সব ধরণের সংকট মোকাবেলা করতে পারব। বাংলাদেশের যে কোন সংকটে ভারত নিশ্চিতভাবেই পাশে থাকবে বলেই আমাদের জনগণ প্রত্যাশা করে। অতীত কিংবা নিকট অতীতেও তা প্রমাণিত।
বহুমাত্রিক.কম: বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে আমাদের অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা এই মাধ্যমটিকে কতটুকু সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি?
অরিন্দম মুখার্জী: এই উপমহাদেশ রবীন্দ্রনাথ -নজরুল-লালনের মতো অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কর্মভূমি। সংস্কৃতি এই অঞ্চলের মানুষের রক্তে প্রবাহিত। সাংস্কৃতিক চিন্তভাবনা বাংলাদেশ-ভারতে দু’দেশেই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার প্রসার আরও বেশি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে আমি যদি বাংলাদেশের বহু মানুষের সঙ্গে মিশি, তাদের সঙ্গে কথা বলি, বেশিরভাগই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা এই কথা বলেন যে, দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি এই সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির আরও প্রচার ও প্রসার হওয়া দরকার। এমন একটা মেকানিজম করা যায় কিনা যে ভারত থেকে কোন সাংস্কৃতিক টিম বাংলাদেশে ৬৪ জেলায় তারা ভ্রমণ করলো। মনে রাখতে হবে, ভারত তো বড় জায়গা শুধু বাংলা নয়, অনেক রাজ্য রয়েছে দেশটিতে। তাদের অনেক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রয়েছে। সেটা যদি বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, আবার বাংলাদেশের নিজস্ব ভূমিজ সংস্কৃতি রয়েছে। লোকগান, লোকনৃত্য তথা লোকসংস্কৃতি এখানকার গৌরব। বাংলাদেশের এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও চেতনা ভারতেরবর্ষের অন্যান্য রাজ্যেও যদি পৌছে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা আরও সম্পষ্ট হবে। তারা আরও বেশি জানতে পারবে। নিশ্চিতভাবে দুই দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের; বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্টভাকে বেশি কাজ করা উচিত।
বহুমাত্রিক.কম: আপনি নিশ্চিয় লক্ষ্য করেছেন, সাম্প্রতিক দশকে বিভিন্ন মানদণ্ডে বাংলাদেশ এগিয়েছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন-
অরিন্দম মুখার্জী: এক কথায় খুবই সুন্দর। আমি প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছি। এখানে আগে যে বাংলাদেশ আমি দেখেছি আর বর্তমানে আমরা একটা সুন্দর পরিবর্তন দেখতে পারছি। যে উন্নয়ন হচ্ছে , মানুষের হাতে অর্থ অনেক এসেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। খুবই পজেটিভ...আগামী দিনে বাংলাদেশে উন্নয়নের এই ধারাটা এগিয়ে নিতে পারলে দেশটি আরও অনেকদূর এগুতে পারবে।
বহুমাত্রিক.কম: বলা যায় আমরা কিছু ক্ষেত্রে দুই দেশ একধরণের অভিন্ন সংকট পার করছি। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও প্রগতির বড় অন্তরায় হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। এই অঞ্চলের এক ধরণের বিষবাষ্প। সাম্প্রদায়িকতার অচলায়তন থেকে এই অঞ্চলের প্রগতিশীল শক্তির ব্যাপক উন্মেষের ক্ষেত্রে কি ভূমিকা নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন-
অরিন্দম মুখার্জী: সাম্প্রদায়িকতা উপমহাদেশে নিশ্চিতভাবেই একটি বড় সমস্যা। এটার অনেক ধরণের কারণ আছে। এটা যে দেশের মধ্যেই বিভিন্ন ধরণের কারণ সেটাই নয়। বর্হিবিশ্ব থেকেও বিভিন্ন কিছুর প্রভাব এখানে আসে এবং এর ফলে এখানে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়। আমার মনে হয় এই সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে না পারলে কোন দিনই একটি দেশের প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণের কাজ শুধু সরেকার করলে এটা সম্ভব হবে না। সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথমে আমার নিজের ঘরে সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করেছে কিনা সেটা দেখতে হবে এবং তা দূর করতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সরকার তো নীতিমালা প্রণয়ণ করবে। সেটা তৃণমূলে পৌছে দেওয়ার কাজ সরকারর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ব্যক্তি-মানুষকে, বিভিন্ন সংগঠনকে করতে হবে। তাহলেই এটা করা সম্ভব ।