Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

অগ্রাহায়ণ ৬ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

‘যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ’র স্বীকৃতি নির্ভর করে কৌশলগত অংশদারিত্বের উপর’‘

প্রকাশিত: ১১:৩২, ৮ জানুয়ারি ২০২৪

প্রিন্ট:

‘যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ’র স্বীকৃতি নির্ভর করে কৌশলগত অংশদারিত্বের উপর’‘

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ছবি: সংগৃহীত

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস এন্ড লিবার্টি (BSMRIPL)’র পরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বীকৃতি নির্ভর করছে ভোটার উপস্থিতির উপর। তবে তাদের সঙ্গে কৌশলগত অংশদারিত্ব কোন স্তরে রয়েছে তার ভিত্তিতে অনেকটা নির্ভর করে বলেও মনে করেন তিনি। মিশরের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের দৃষ্টান্ত টেনে এই মন্তব্য করেন ড. আবুল বারকাত। 

বহুমাত্রিক.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন তিনি। কথা বলেছেন প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম। 

বহুমাত্রিক.কম: আজকের এই নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত: এখন দেখার বিষয় ভোটার উপস্থিতি। উপস্থিতিটা ভালো হওয়া দরকার। ভালো বলতে কত পার্সেন্ট আমি জানি না, তবে ৫০ ভাগের বেশি হলে খুবই ভালো হয়। আর ভোটার উপস্থিতি যদি কম হয়, তাহলে…একটি জাতীয় নির্বাচন হওয়ার পর পরই কিন্তু অনেক দেশ অভিনন্দন জানাতে শুরু করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কংগ্রাচুলেট করবে কিনা তা নির্ভর করে ভোটার উপস্থিতির ওপর। ইজিপ্টে ক’দিন আগে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪৫ শতাংশ। ওদের হিসাবে তা বেশি নয়, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রিকগনিশন দিয়ে দিয়েছে। ঘটনা অনেকটা আমাদের মতোই। ওদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্ব আছে। আমার ধারণা, সেখানে যদি ৩০ শতাংশ হতো তবেও রিকগনিশন পেত। কিন্তু আমাদের এখানে ৪০-৫০ শতাংশের কম হলে কি করবে তা সন্ধ্যায় বা রাতে দেখা যাবে। কাল থেকে পরবর্তী কয়েকদিন হয়তো বোঝা যাবে বহিঃশক্তি কিভাবে গ্রহণ করলো। ভারত-চীন করবে বলেই মনে হয়। জাপানের কথা এখনি বলা যাবে না। 

বহুমাত্রিক.কম: কিন্তু গেল কয়েক দিন সাধারণ মানুষের ওপর যে আক্রমণ হলো সেখানে সরকার বা আইনশঙ্খলাবাহিনীর ভূমিকাকে কিভাবে বর্ণনা করবেন..

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত: একটি বড় দল (বিএনপি), সঙ্গে জামায়াত যেখানে নির্বাচন বর্জন করে কয়েক মাস ধরে সহিংস কর্মসূচি নিয়ে মাঠে, সেখানে এটি কি নিশ্চিত করা সম্ভব। সেখানে পরশু ট্রেনে আগুন দেওয়ার যে ঘটনা আমরা দেখলাম, সেখানে কয়েকজন ইতিমধ্যে আটকও হয়েছে। ট্রেনটিতে বেশিরভাগ যাত্রী কিন্তু আগেই নেমে গিয়েছিলেন, যদি সব যাত্রীরা থাকতেন তবে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারতো। ৪-৫ জনের সংখ্যা তখন থাকতো না, ৫-৬ শ’ হতে পারতো। এতে বলা যায়, নাশকতাকারীদের বড় ধরণের অঘটন ঘটানোর সক্ষমতা আছে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।    

বহুমাত্রিক.কম: সাধারণ মানুষই সব সময় বলি হচ্ছে, উত্তরণের পথ কি? 

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত:  সাধারণ মানুষরাই সব সময় বলি হয়, সুবিধা পায় অসাধারণরা। এই সংকট থেকে উত্তরণে এক ধরণের সামাজিক চুক্তি লাগে (স্যোশাল কনসেনসাস)। এখন এক পক্ষ যদি গো-ই ধরে, যেমন বিএনপি-জামায়াত কোন সামাজিক চুক্তির মধ্যে নেই। তাদের বক্তব্য, ‘আমাদের একটাই চাওয়া, উনাকে (শেখ হাসিনাকে) নেমে যেতে হবে, তাহলেই আমরা নির্বাচনে যাব।’ এখন তিনি নেমে যাবেনইবা কেমন করে, সাংবিধানিকভাবে তো এটা আর সম্ভব না। এতোদিন ধরে এই যে আন্দোলন..সেই ২০১১ সাল থেকে; কেয়ারটেকার থাকবে না, এটা তো এগারো সালের কথা-এখন ২০২৪ সাল। আওয়ামীলীগ যেটি বলে, জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধীদের দল। বিএনপি সম্পর্কে এখন যেটা বলা হচ্ছে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসবাদী দল।  তাদের কর্মকাণ্ড সহিংসতামূলক। এটা নিয়েও তো একটা কনসেনসাস লাগে যে, একটি সন্ত্রাসবাদী দল-হিসেব করলে দেখা যায় যে ওয়ান-থার্ড ভোটার তাদের পছন্দ করে। এটাও তো ফেলে দেওয়ার বিষয় না। যদিওবা জার্মানিতে ৮০ ভাগ ভোটার পছন্দ করেছিল হিটলারকে। যখন হিটলার ইতিমধ্যে প্রায় হিটলার হয়ে উঠেছিল। যখন তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন, সেই সময় জনগণ তাকে পছন্দও করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সে হিটলার বনে গেল বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে! জার্মানের জনগণ যদি জানতো যে হিটলার একটি বিশ্বযুদ্ধ বাধাবে, দুনিয়াতে এত লোক হত্যা করবে তাহলে কি তারা হিটলারকে ভোট দিত। পরবর্তীকালে উগ্র জাতীয়তাবাদী বা সমিনিষ্টরা জার্মানিতে দলও বানিয়েছে, কিন্তু তারা আর ভোট পায় না। জার্মান জাতি বুঝে গেছে, কেউ খুব জনপ্রিয় হলেই তাকে ভোট দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী বানিয়ে দিতে হবে, এটা ঠিক হবে না। সমান্তরালে এখানেও যে ওয়ান-থার্ড লোক বিএনপি’র আর ৫ ভাগ লোক জামায়াতের। এই ভোটাররা কি মনে করে বিএনপি, কি মনে করে জামায়াত হয় এটাও তো দেখার বিষয়। সেটাও তো এড্রেস আমরা কখনও করিনি-এটা একটা দিক।  অন্যদিকে আওয়ামীলীগের কথা যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল। সেই মুক্তিযুদ্ধের তো একটা প্রক্লামেশন অব ইন্ডপেন্ডেন্স বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল। সেখানে বলা ছিল, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশটা কেমন হবে। সেই দেশটা বৈষম্যহীন, সেক্যুলার মাইন্ডসেটের হবে, অসাম্প্রদায়িক হবে, এটা তো আওয়ামীলীগও করেনি। একই কথা যদি বলা হয়, বিএনপি তো দাবি করে জিয়াউর রহমান ঘোষক। ঠিক তিনি যদি ঘোষকই হন-তাহলে তিনি যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, ঘোষণাপত্র পাঠের যে স্পিরিটটা; সেটা তো মুক্তিযুদ্ধেরই স্পিরিট-তাহলে বিএনপি কোন স্পিরিটে চলে? জাস্ট উল্টোটা। 

বহুমাত্রিক.কম: তার মানে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির একটি স্ববিরোধী জায়গা আছে? 

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত: হ্যা, জন্মসূত্রে দলের যে মতাদর্শটি সেটা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে একটি স্ববিরোধী অবস্থান তৈরি হয়েছে। সেই স্ববিরোধী অবস্থানটা কোথায় বেশি, কোথায় কম-সেটা দেখার বিষয়। সেটা বলা যায়, এই স্ববিরোধিতা বিএনপি’তে প্রচুর বেশি। আওয়ামীলীগ তারপরেও তো…। জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক, এইটা পরিপূর্ণভোবে বিশ্বাস না করলে যা হয়-সেটাই হচ্ছে। সাধারণ মানুষই মারা যাবে। এর উত্তরণে সময় লাগবে। তবে পলিটিশিয়ানসদের বুঝতে হবে বিষয়টা। এরকম চলতে থাকলে তো একটা গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি হবে। দেশটা এগিয়ে যাচ্ছিল। এখানে বৈষম্য-দারিদ্র আছে, গরীব-মধ্যবিত্তের কষ্ট আছে। বিভিন্ন মাপকাঠি দিয়ে মাপলে তো এটা বলা যাবে যে, আমরা একটি জায়গায় যাচ্ছিলাম। সেটা নিয়েও তো একটা কনসেসাস হতে পারতো। 

বহুমাত্রিক.কম: এই যে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে, সাধারণ মানুষের উত্তরণটা তাহলে কোনপথে হবে?  

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত: কোনপথে হবে, আর কোনপথে হওয়া উচিত আরেক কথা। কোনপথে হবে তা আমরা প্রায় জানি। বাংলাদেশে একধরণের ক্যাপিটালিজম তৈরি হয়েছে। এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্টের জন্য এক ধরণের নিউ লিবারাল পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে পুঁজির সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ যেটি সেটি দেখতে পাচ্ছি। ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিক্স-সবই দেখা যাচ্ছে। এটা যদি কন্টিনিউ করে তাহলে যা দেখছি এটাই কন্টিনিউ করবে। আর যদি এটা মধ্যেই-কেমন হওয়া উচিত, সেই কথা আসে, সেটা করা অসম্ভব তা কিন্তু না। যেমন হওয়া উচিতভরতে গেলে, কম বৈষম্যপূর্ণ সেক্যুলার মানসিকতার আলোকিত মানুষ প্রয়োজন। অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ এখানে আছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী আছে। কোন দিকে যাচ্ছে-আর কোন দিকে যাওয়া উচিত তা এক কথা না-আমার মতে। যেদিকে যাওয়া উচিত, সেইদিকে নেওয়া সম্ভব। 

বহুমাত্রিক.কম: কোন পথে সেটি?  

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত: যাঁরা আছেন ক্ষমতায় তাঁরাই যদি আরও কতগুলি কাজ করেন, যেমন- যদি স্বাস্থ্যের কথা বলি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। স্বাস্থ্যসেবাকে পুরোপুরি রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়ে আসা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা বলতেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ডায়াগনষ্টিক সেন্টার বুঝি-এগুলো ঠিক নয়। এটা ঠিক করা সম্ভব। মেগা প্রজেক্ট করবেন? এটা নিয়েই মেগা প্রজেক্ট করুন। শিক্ষাক্ষেত্রে যদি বলি, কারিকুলাম নিয়ে যেসব কথাবার্তা শুরু হয়েছে, এটা পেছনের দিকে যাওয়া। সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী যেগুলো আছে, তা কোনভাবেই ভিক্ষা হওয়া উচিত নয়, এটি অধিকার। সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর ১২০-২২টি ধাপ রয়েছে, বিধবা ভাতা-বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি। দারিদ্রের তো অনেক রূপ, এটি বাড়ছেই-কমছে না। দারিদ্রের যে সংখ্যা দেখানো হয়, আগে বেশি ছিল-এখন কম, ভবিষ্যতে থাকবে না-এটি দেখানো এক জিনিস আর বাস্তবতা আরেক জিনিসি। আওয়ামীলীগের ইশতেহারেও রয়েছে এসব কথা। বিশেষ করে দুর্নীতি-অর্থপাচার, ইশতেহারে বিচার করে সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথাও বলা আছে। এটি কাজে লাগালেই হয়।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer