Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

পৌষ ৭ ১৪৩১, রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

সাক্ষাৎকারে কবি ইজাজ আহমেদ মিলন

‘একদিনের জন্যও আমি থেমে থাকিনি’

ফাহিম আহমেদ মন্ডল

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৪ জুন ২০২১

আপডেট: ০৯:৩৫, ২৪ জুন ২০২১

প্রিন্ট:

‘একদিনের জন্যও আমি থেমে থাকিনি’

-কবি ইজাজ আহমেদ মিলন। ছবি- সংগৃহীত

কবি ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন। প্রান্তিক মানুষের জীবনের ইতিবৃত্তকে লেখনিতে ধারণ করে তার সার্থক রূপায়ন করে চলছেন তিনি। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও তাঁর কবিসত্ত্বায় পল্লবিত হয় প্রান্তজনের হৃদয়ের আকুতি। বোধহয় সেজন্যই তিনি লিখতে পারেন, ‘নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্র জলে’র মতো কাব্যগ্রন্থ।

ক্রমেই তাঁর বিকাশমান লেখক সত্ত্বা অনুসন্ধান করে ফেরে বিস্মৃত ইতিহাস কিংবা সমকালীন সংকট-সম্ভাবনার বিচিত্র সব আখ্যান। সম্মানজনক বেশকিছু লেখক পুরস্কারে অভিষিক্ত তরুণ কবি ইজাজ আহমেদ মিলন সম্প্রতি লাভ করেছেন ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২০’। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য শ্রেণিতে ‘১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ এর জন্য এই পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। 

কবি ইজাজ আহমেদ মিলন তাঁর সাহিত্য জীবনের নানাদিক নিয়ে সম্প্রতি বহুমাত্রিক.কম এর মুখোমুখি হয়েছিলেন। জানিয়েছেন তাঁর একান্ত অনেক কথা। ইজাজ আহমেদ মিলনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফাহিম আহমেদ মন্ডল। 

পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি এখানে তুলে তুলে ধরা হল-

বহুমাত্রিক.কম: আপনাকে অভিনন্দন। কেমন আছেন আপনি?

ইজাজ আহমেদ মিলন: ভালো থাকার মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। এমনি সব সময় ভালো থাকার চেষ্টা করি। আপনি যে কারণে আমাকে অভিনন্দন দিলেন, অভিনন্দিত করলেন, ঠিক এ কারণেই ভালো থাকার মাত্রাটা আরও বেড়ে গেছে। 

বহুমাত্রিক.কম: কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার লাভ করেছেন আপনি। এই প্রাপ্তির অনুভূতি যদি জানান-

ইজাজ আহমেদ মিলন: আসলে আমার চলার পথটা অনেক লম্বা। মাঝামাঝিও আসতে পারিনি এখনো, সেই চলার পথে যদি ধরুন, দশটা ধাপের একটি ধাপ আমি এসেছি। আরও অনেকটা পথ পড়ে আছে। আমার চলার পথটা কখনোই মসৃণ ছিল না। বন্ধুর পথে হেটে হেটে আজ আমি এ পর্যন্ত এসেছি। এর তৃপ্তিটা বোধহয় একটু ভিন্ন। ভালো লাগাটা বেশি। ডানে-বামে সামনে পেছনে কাটা বিছানো ছিল। কন্টকময় বলয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের এতো বড় একটি পুরস্কার, ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত আছেন, যাঁরা সাহিত্যপ্রেমী, যাঁরা সাহিত্যকে ভালোবাসেন-প্রত্যেকেই জানেন, দেশের গ্রহণযোগ্য সাহিত্য পুরস্কারের অন্যতম একটি এটি। এই পুরস্কারটার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আসলে আমি খোঁজে পাইনি। যখন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ফোন করে আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন, তখন ঘড়ির কাটা ৭টা ৪২ মিনিট হবে...বিশ্বাস করুন আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম। অন্তত দুই মিনিট কথাই বলতে পারিনি। আবেগ-অনুভূতিটা তখন এতোটাই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে, আমার ভাষাকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি পুরস্কার এর আগেও পেয়েছি, যেমন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পুরস্কার দেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য, বজলুর রহমান স্মৃতিপদক পুরস্কারটি আমি দু’বার পেয়েছি, তখনও অনুভূতি হয়েছিল..তবে এতোটা আবেগপ্রবণ হইনি। এতোটা বেশি আমাকে আলোড়িত করেনি। এতোটা বেশি আনন্দ দেয়নি, যেমনটা দিয়েছে কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পর। 

বহুমাত্রিক.কম: যেমনটা আপনি বলছিলেন, এর আগেও অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেছেন। কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন? 

ইজাজ আহমেদ মিলন: স্থান-কাল-পাত্র ভেদে গতিপথ পরিবর্তন ঘটে। যেমন ২০০৯ সালে ‘নষ্ট শরীর ভেজে না রৌদ্র জলে’ গ্রন্থটির জন্য ইমপ্রেস টেলিফিল্মস চ্যানেল আই’র সিটি-আনন্দআলো সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলাম। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান সরাসরি লাইভ করেছিল, তখন আমার সঙ্গে পুরস্কার পেয়েছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুল হক। সেই তালিকায় আমার মতো অখ্যাত লেখক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল, তখন সেই লাইভ অনুষ্ঠানে আমি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেই ফেলেছিলাম-এই পুরস্কারটা আমার কাছে নোবেল পুরস্কারের মতোই মর্াদাবান মনে হচ্ছে। এই কথার প্রতিবাদ করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। তিনি বলেছিলেন, ‘ইজাজ আহমেদ মিলন যেটা বললো সেটা তাঁর আবেগের জায়গা থেকে বলেছে।’ আজ দশ বছর পরে আমার মনে হচ্ছে, এটা বলে আমি ঠিক করিনি। যদিও তখনকার সময়ে ওটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তখন ওই পুরস্কার না পেলে আজ আমার কালি ও কলম পুরস্কারের জায়গায় আসতে প্রেরণা কাজ করতো না। এবং আপনি শুনে অবাক হবেন, এই পুরস্কার পাওয়ার পর আমার বন্ধু বহুমাত্রিক.কম সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম কোন একটি দৈনিকে লিখেছিলো-‘ওই নূতনের কেতন ওড়ে’ । আশরাফুলের ওই লেখা আমার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। সিটি আনন্দআলো সাহিত্য পুরস্কার আমার নেপথ্য অনুপ্রেরণা। এর কথা আমাকে বলতেই হবে। তখন এই পুরস্কারটা আমাকে এতোটাই উৎসাহিত করেছিল, সেই উৎসাহে আমি ২০১৫ সালে এসে বজলুর রহমান স্মৃতি পদকের মতো পুরস্কারেও পেয়েছি। একদিনের জন্যও আমি থেমে থাকিনি। আমি আমার কাজ কনটিনিউ করেছি-এই পুরস্কারগুলো আমাকে আরও দায়িত্বশীল করে তুলেছে।  

বহুমাত্রিক.কম: ‘১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ বইটি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন-

ইজাজ আহমেদ মিলন: বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস ১৯৭১। বাড়িয়া গাজীপুরের একটি অঞ্চল। তিন দিকেই হচ্ছে বিল। এর তীরবর্তী গ্রামের নাম বাড়িয়া। পূর্বদিকে কালিগঞ্জ উপজেলা। পশ্চিমে জয়দেবপুর। এই গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত একটি এলাকা। ১৯৭১ এর মে মাসে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে সারা দেশে তখন সর্বত্র যুদ্ধ যুদ্ধ আর যুদ্ধ। মানুষ পাখির মতো গুলি করে মারছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। নারীদের ঘরে থেকে বের করে পাশবিক নিপীড়ন করে হত্যা করা হচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে ..দিনটি ছিল শুক্রবার। আগেই বলেছি ওই অঞ্চলটিতে বেশির ভাগ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই এলাকাটিই বেছে নেয় পাকিস্তানি হানাদারনরপশুর দল। অধিবাসীরা বাঁচবার জন্য বেলাই বিল সাঁতরে শত শত মানুষ কোলে-কাঁখে সন্তানদের নিয়ে পার হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে যাঁরা পার হতে পারে নাই, তাদের ঘরের ভেতরে রেখে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতো। বাঁচতে চাইলে অনেক বাবা-ছেলেকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে মারা হয়েছিল।  মা-মেয়েকে একসঙ্গে..অসংখ্য মানুষ সেখানে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় তিন শত মানুষ..যতটুকু আমি জানতে পেরেছি। তাদের রক্তে বেলাই বিল লাল হয়ে যায়। ১৪ মে (১৯৭১) জুমার নামাজের পর থেকে এই হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কিন্তু পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে এতো বড় একটি গণহত্যা, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৬ খণ্ডের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সেখানে বাড়িয়া গণহত্যার কথা কোথাও উল্লেখ নেই। যখন আমি দেখলাম আমাকে প্রবল ভাবে আহত করলো। তখন আমি ভাবলাম, আমি বোধহয় এটি নিয়ে কাজ করতে পারি। তখন বিজয় দাশ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর মা এবং সাংবাদিক আশরাফুল আলম আয়ুবের সহযোগিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় এলাকায় অবস্থান করে অনুসন্ধান করি। প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ চমৎকারভাবে বইটি প্রকাশ করেছে। রকমারি ডটকম এ ২০২০ সালে বেস্ট সেলার ছিল ‘১৯৭১ঃবিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ বইটি। 

(অসমাপ্ত) 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer