ছবি- বহুমাত্রিক.কম
জিল্লুর রহমান। একজন মুক্তিযোদ্ধা। আগরতলা বকুলনগর ক্যাম্পে ছয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের ফিজিক্যাল ইন্সস্ট্রাকটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। হেড কোয়ার্টারের সতেরো জনের মধ্যে ছিলেন একজন। বাংলাদেশে সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর, ঢাকার তেমোহনী, রাজারবাগসহ বিভিন্ন এলাকায়। সিনেমা ও নাটকের গুণী অভিনেতা হিসেবে পার করেছেন ৫০ বছর। ইত্যাদির শিল্পী হিসেবে রয়েছে তাঁর বিশেষ পরিচিতি। গুণী এই মানুষটির মুক্তিযুদ্ধ এবং অভিনয় জীবনের কথা তুলে ধরেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তুষার কান্তি সরকার
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট জানতে চাই।
জিল্লুর রহমান: ১৯৭১ সালের মে মাস। গ্রামের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানিরা। বিক্রমপুরের ছেলে আমি। মানসিক ভারসাম্যহীন একজন লোক ছিল আমাদের গ্রামে। ওকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিরা। নির্বিচারে হত্যা করা মানুষের বিভৎস লাশ আর আগুনে পোড়া গ্রামের পর গ্রাম দেখে মনের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মনে মনে শপথ নেইÑ মুক্তিযুদ্ধে যাব। নিরপরাধ মানুষ হত্যার বদলা নেব।
প্রশ্ন: এরপর কী করলেন?
জিল্লুর রহমান: তখনো মেট্রিক পরীক্ষা দেইনি। বয়স কম। চাচাতো ভাই মিলে আমরা ছিলাম ছয়জন। সিদ্ধান্ত নিলাম- যুদ্ধ যাব। স্থানীয় মসজিদে মিলাদ দিলাম। এর পর দিন সকাল পাঁচটায় রওয়া দিলাম। হেঁটে পৌঁছালাম বিক্রমপুর লঞ্চঘাটে। ওখান থেকে কুমিল্লার ষাইটনল যাই। তারপর চাঁদপুর হয়ে বক্সসনগর বর্ডার দিয়ে বিশালগড় হয়ে ১৪ মাইল হেঁটে আগরতলা পৌঁছাই। ওখানে আমরা কংগ্রেস ভবনে উঠি। সবাই ওখানেই ওঠেন। আগরতলাতে বাংলাদেশের এমপিদের থাকার একটা ভবন ছিল। গাজী গোলাম মোস্তফা ছিলেন আমাদের এলাকার এমপি এবং গর্ভনর। তাঁর কাছে গেলাম। তিনি একটা চিঠি লিখে বললেন, বকুলনগর ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন শামসুল হক। তোমরা ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করো।
প্রশ্ন: তখন কি পুরোদমে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে?
জিল্লুর রহমান: না। তিনটা মাত্র তাঁবু ছিল বকুলনগরে। মোট আমরা ছিলাম একুশ জন। আমাদের ফিজিক্যাল ট্রেনিং হতো। আমার কার্যকলাপ আর পারদর্শিতায় খুশি হয়ে প্রশিক্ষকরা আমাকে ‘ফিজিক্যাল ইন্সস্ট্রাকটর’ হিসেবে নিযুক্ত করেন। এরপর শ’ শ’ মানুষ ট্রেনিংয়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে আসতে থাকে। বকুলনগরের হেড কোয়ার্টারের সতেরোজনের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। সরকার আমাকে ১৫০ টাকা ভাতা দিত। ঢাকার বাসাবো এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ আমার কাছে চিঠি দিয়ে লোকজন ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাতেন। আমি পাঁচ শতাধিক মানুষকে তখন বিক্রুট করেছিলাম। বকুলনগর দুটো ক্যাম্প ছিল। একটা পদ্মা। একটা মেঘনা। আমরা ছিলাম পদ্মায়। কিছু দিন পর রাইফেল এবং গ্রেনেট ট্রেনিং শুরু হয়। তিনটা তাঁবু থেকে ১৪৭টি তাঁবু ভরে যায়। পদ্মায় তখন পনেরো’শো মানুষ ট্রেনিং নিচ্ছে।
প্রশ্ন: ক্যাম্পের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ কেমন ছিল?
জিল্লুর রহমান: টিনের প্লেটে খেতাম। শুধু ডাল-ভাত। একদিন খাওয়ার সময় আমার প্লেটে একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে। আমি সেটাকে ফেলে দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। প্রথম অবস্থায় খাওয়া-দাওয়ায় খুব কষ্ট হতো। এক তাঁবুতে থাকতাম ছয়জন। বিছানাপত্র বলতে নিচে অয়েলক্লথ আর মাথায় একখানা ইট। আমরা খাল, পকুর, বিলের পানি পান করতাম। তাঁবুতে প্রায়ই দেখা যেত পাহাড়ি লাল বিছা উৎপাত। বিছায় কামড়ালে মানুষের মারা যাবার সম্ভাবনাও ছিল।
প্রশ্ন: শরণার্থীদের কথা কিছু বলুন।
জিল্লুর রহমান: এক হিন্দু পরিবারের কথা আমার খুব মনে পড়ে। মহিলার সঙ্গে ছয়-সাত বছরের একটি মেয়ে আর ছেলেটার বয়স তিন-চার বছর হবে। ওরা ঘুরঘুর করছিল আমার হেড কোয়ার্টারের আশপাশে। মহিলার চোখে পানি। বলল, নাম লিখাতে না পারায় দুদিন ছেলেমেয়ে কিছু খায়নি। কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি তখন স্টোরের ইনচার্জ ছিলাম। ওদের জন্য চাল-ডাল যা পারলাম লুকিয়ে দিয়ে দিলাম। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আনা মশারী, খাবার, চিনি, চাল, ডাল, গামছা ইত্যাদি আমি শরণার্থীদের অনেক দিয়েছি। জানতাম, এটা ছিল অন্যায়। কিন্তু ওদের করুণ মুখগুলো দেখে আমি না করতে পারতাম না। একবার চাল-ডাল দেয়ার সময় ধরা পড়লাম ক্যাপ্টেনের কাছে। শাস্তি হলো- বারো ঘণ্টা একটা ঘরে আটকে রাখা। এতে আমার কোনো দুঃখবোধ ছিল না। কেননা- যা করেছি তা আমার দেশের মানুষদের জন্য করেছি।
প্রশ্ন: অবসর সময় কি করতেন?
জিল্লুর রহমান: সন্ধ্যার দিকে আমি ফ্রি হয়ে যেতাম। কোনো কোনো দিন আগরতলার সুব্রত হোটেলে যেতাম। বাঙালি নেতাদের আনাগোনা ছিল ওখানে। বাংলাদেশের সব খবর পাওয়া যেত। আবার কোনো কোনো দিন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশপ্রেমের নাটক মঞ্চায়ন করতাম। দেশের গান শেখাতাম। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম...’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...।’ একদিন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় হঠাৎ আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। আমি তাঁকে গান গেয়ে শুনাইÑ ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে আশ্রুজলে...’। উনি খুব খুশি হলেন। বললেন, চালিয়ে যাও, এ সময় বিনোদনেরও দরকার আছে। ক্যাম্পে মাইক লাগানো থাকতো। সেখানে আব্দুল জব্বার, আপেল মাহমুদসহ অনেকের গান বাজতো।
প্রশ্ন: সন্মুখ যুদ্ধের কথা জানতে চাই।
জিল্লুর রহমান: তখন যুবলীগের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মণি, ছাত্রনেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, মোঃ জিন্নাসহ কয়েকজন আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। আমাকে ট্রেইনার হিসেবে তাঁদের পছন্দ হওয়ায় আমাকে নিয়ে যান আগরতলার কলেজটিলায়। ওখানে আমার মতো আরো অনেকে ছিলেন যাদের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বাছাই করে আনা হয়েছে। সবার ভেতর থেকে আমিসহ আরো পাঁচজনকে সিলেক্ট করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরে আমরা একটা সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। জয় হয় আমাদের। এরপর ঢাকায় এসে তেমোহনী, রাজারবাগ ইত্যাদি এলাকার রাজাকারদের দমন ও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করি। মেজর হায়দারের অধীনে ২ নম্বর সেক্টর ছিলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে আরো মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিয়েছিলেন। সবাই মিলে যুদ্ধ করতাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার অনেক এমপি এবং নেতাদের পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে আমি ভারতে যেতে সাহায্য করেছি।
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ অভিনয় জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
জিল্লুর রহমান: স্বাধীনতার পর বিটিভি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম আমার সাক্ষাৎকার নেয়। এরপর তারা আমাকে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেয়। আমি রাজী হয়ে যাই। অডিশন হয়। তাতে পাশ করি। আমার প্রথম অভিনীত নাটক ‘রক্তে ভেজা শাপলা’। প্রযোজনা: আতিকুল হক চৌধুরী। লেখক: অভিনেতা আব্দুল সাত্তার। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের। আবদুল্লা আল মামুনের ‘সংসপ্তক’ নাটকে আমি হাসেম চরিত্রে অভিনয় করেছি। এছাড়া অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক হলো- আরেক ফাগুন, একটি সেতুর গল্প, হিরামন, মাটির কোলে, অনন্ত নিবাস ইত্যাদি। বাংলাদেশ বেতারে ‘জল্লাদের দরবার’ একটি নাটক করি স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার আগে ‘বেদের মেয়ে’ এরপর ‘পাতালপুরের রাজকন্যা’, ‘কি যে করি’, ‘দস্যু বনহুর’, ‘এপার ওপার’, ‘মাসুদ রানা’, ‘বাহাদূর’, ‘রাজদুলারী’সহ বিভিন্ন সিনেমায় অভিনয় করি। আমার ৪টা কৌতুকের ক্যাসেট ছিলÑ ‘ভাতিজা কি কয়’, ‘চান্দের দেশে ভাতিজা’, ‘ পাগলা ঘোড়া’ ও ‘আসছে ভাতিজা’।
প্রশ্ন: বিজয়ের পঞ্চাশে এসে পূর্ণতা-অপূর্ণতা কথা জানতে চাই।
জিল্লুর রহমান: দেশ এগিয়েছে, কিন্তু সততায় পিছিয়ে। এখনো দেশে পাকিস্তানি সমর্থক গোষ্ঠী আছে। ঘৃণা করি এদের। স্বাধীন দেশে দেশদ্রোহী থাকতে পারে না। আরেকটা যুদ্ধ করে এদের দেশ ছাড়া করতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। আর এ দায়িত্বটা নিতে হবে আমাদেরই।
বহুমাত্রিক.কম