Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

অগ্রাহায়ণ ৬ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ‘প্রকৃত সত্য’ জানালেন গেরিলা যোদ্ধারা 

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:০৬, ১৩ মে ২০২৩

আপডেট: ১৯:১১, ১৩ মে ২০২৩

প্রিন্ট:

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ‘প্রকৃত সত্য’ জানালেন গেরিলা যোদ্ধারা 

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক’ নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলা রাজনৈতিক বিতর্কের মাঝে ‘প্রকৃত ইতিহাস’ তুলে ধরলেন চট্টগ্রামের কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। সংস্কৃতিবোদ্ধা, সংগ্রাহক ও উদ্যোক্তা তারিকুল ইসলাম জুয়েলের আয়োজনে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ‘মুক্তির কথন’ শীর্ষক এক বৈঠকী আড্ডায় যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বহু অকথিত অধ্যায় তুলে ধরেন তাঁরা।  শুক্রবার (১২ মে) চট্টগ্রাম শহরের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বিপরীতে পাহাড়চূড়ায় তারেক জুয়েলের বাংলোয় এই আড্ডা অনুষ্ঠিত হয়।

একাত্তরের রণাঙ্গনে চট্টগ্রাম শহরে সক্রিয় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ দল ‘হিট অ্যান্ড রান’ এর কয়েকজন সদস্য ‘মুক্তি কথন’ এ যোগ দিয়ে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহুল রাজনৈতিক বিতর্কিত ও চর্চিত বিষয় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা’ নিয়ে কথা বলেন। তাদের ভাষ্যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তাঁর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি মগবাজার ওয়ারল্যাস থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনে আসার পর তা পৃথকভাবে অন্ততঃ ৫জন ব্যক্তি ঘোষণা করেন। তৎকালীন জেড ফোর্স অধিনায়ক জিয়াউর রহমান হচ্ছেন ৫ম ব্যক্তি; যিনি  এই ঘোষণাপত্র পাঠের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর পূর্বে আরও ৪জন ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসটি ‘নোংরা রাজনীতি’র আবর্তে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি জানিয়ে নতুন প্রজন্মকে মুক্তি সংগ্রামের এ সত্যকে তুলে ধরার আহ্বান জানান গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা।      

মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বহু মিথ্যাচার আজ আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  ঘটনার একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। এনিয়ে প্রকৃত সত্যটি হচ্ছে-বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি মগবাজার ওয়্যারলেস মেসেঞ্জারে পৌছায় সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার আঃ কাদেরের কাছে। দলীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬ মার্চ ভোরে আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাটি দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে বেলাল মোহাম্মদ, রাখালচন্দ্র বণিক, রঙ্গলাল সেন, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। জিয়াউর রহমান ৫ম অধিবেশনে ঘোষণাটি পাঠ করেন।’

আড্ডায় এই মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রশ্ন ছিল, তবে কেন আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নানসহ অন্যদের নাম সবাই জানতে পারলেন না? জবাবে এই গবেষক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘জীবদ্দশায় জিয়াও কোনদিন এমন দাবি করেননি। আরও একটি বাস্তব সত্য হচ্ছে-এম এ হান্নানসহ অন্য ঘোষণাকারীদের ইতিহাসে অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার কারণও রয়েছে। সেই সময় স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে বিভক্তি ছিল, কোন্দল ছিল ছাত্রলীগের রাজনীতিতেও। উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে থিতু হওয়া এম এম হান্নানের নাম ঘোষণাকারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার এটি একটি বড় কারণ ছিল। এবং সেই সুযোগটি জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি পরবর্তীতে গ্রহণ করে।’  

মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ‘৪৭-এর দেশভাগ, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থানসহ সে সময় থেকে চলমান বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু অনিবার্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নায়ক জনগণ হলেও বঙ্গবন্ধু সর্বাধিনায়ক ছিলেন, যিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে গাইড করে ছিলেন। আমি গেরিলাযুদ্ধ করেছি, যাকে বলা হয় হিট অ্যান্ড রান। জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নায়ক বলার কারণ অনেকগুলো। তারমধ্যে একটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা।’

‘মুক্তি কথন’র মুখ্য অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক বলেন, ‘যে কোনো মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার একজন মানুষ থাকতে হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার ও দিকনির্দেশনার কাজটি করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ভাষণ নিয়ে একটু বলতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কেবলমাত্র ওই স্থানে উপস্থিত মানুষেরাই শুনতে পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের, এমনকি ঢাকার মানুষেরাও তাঁর ভাষণের রেকর্ড শুনতে পাননি। সেসময় বেতার ও অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের ওয়াক আউটের পর বাধ্য হয়ে পরদিন ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়।’

‘এই ভাষণের পর থেকেই কিন্তু আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার সম্মুখযুদ্ধ করার সৌভাগ্য হয়েছে, মোট ২২টি অপারেশনে আমি অংশ নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বেশিরভাগ অপারেশন ছিল সম্মুখযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ যেমন ছিল, তেমনি একটা অংশ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, যাদের আমরা রাজাকার বলি। তবে বেশিরভাগ জনগণ চায়নি বলেই বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়নি। আজকের প্রজন্মকে এসব ইতিহাস জানতে হবে। তাহলেই তারা অন্তরে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করবে’-যোগ করেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধে না গেলে যে বেঁচে থাকবো এমন কোনো গ্যারান্টি ছিল না। তবে দেশকে স্বাধীন করবো এমন চিন্তাধারা থেকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। কাউকে কিন্তু এপ্রোচ করতে হয়নি। মার্চ থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়েছিল। সত্যি বলতে অস্ত্র সম্পর্কে আমাদের তেমন একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু প্র্যাকক্টিক্যাল ফিল্ডে আমাদের দেওয়া হয়েছিল এসএমজি। আমার সবচেয়ে পছন্দের স্মৃতি ছিল ১৪ ডিসেম্বর। কারণ ওইদিন আমরা বান্দরবান দখল করেছিলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমরা যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন পাকিস্তানিরা পালিয়ে গিয়েছিল।’

বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি তাপস হোড় বলেন, ‘আমি মনে করি আজকের দিনেও আমাদের মাঝে দেশপ্রেম ঠিকই আছে, ঠিক যেমনটা যুদ্ধকালীন সময়ে ছিল। আমি বিশ্বাস করি, এখনও যদি দেশের কোনো বিপর্যয় আসে বর্তমান যুবসমাজও ৭১’র মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তারেক জুয়েলকে আমি ধন্যবাদ জানাই। নিজের জানার তাগাদার পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর তার এই প্র‍য়াসকে আমি সাধুবাদ জানাই।১১ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. শাহ আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘আমরা যুগে যুগে দেখে এসেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন তারা দেশের জন্যই করেছেন। আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে জয় ছাড়া অন্য কোনো টার্গেটই ছিলো না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। তাঁর ভাষণটি শোনার পর আমি আর ঘরে থাকতে পারিনি। মা-বাবার অবাধ্য হয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। স্বাধীনতার জন্য এতোটাই উন্মুখ ছিলাম।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল করিম কাজল বলেন, ‘আমি নিজেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বৈষম্যের শিকার হতে দেখেছি। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় আমরা যুদ্ধে চলে যাই। আমি তখন কমার্স কলেজে ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলাম। আমি মূলত গেরিলা ছিলাম, হিট অ্যান্ড রান। আমরা বড় অস্ত্র নিয়ে মুভ করতাম না। আমরা প্রথমে স্পট ঠিক করতাম, একই সাথে পালানোর রাস্তাও ঠিক করে রাখতাম। ট্রান্সফরমার ধ্বংস, গ্রেনেড চার্জ করাসহ ছোটখাটো এক্সপ্লোশন করতাম। পাকিস্তানি ও রাজাকারদের জানান দিতাম মুক্তিযোদ্ধারা আছে। এতে তাদের মধ্যে ভয় কাজ করতো।’

সৌখিন অ্যান্টিক সংগ্রাহক ও শিল্পোদ্যোক্তা তারিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘সত্তরের দশকে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা আবেগ কাজ করে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মাঝে এটা তেমন একটা দেখা যায় না। আমি মনে করি যতদিন পর্যন্ত আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সঠিক ইতিহাস নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারবো না, ততোদিন আমরা নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করতে পারি না। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে ছড়িয়ে দিতেই আমি ও আমার পরিবারের আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।’

এসময় নিউইয়র্ক থেকে তৎকালীন সময়ে (১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর) প্রকাশিত ম্যাগাজিন নিউজউইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি কাভার পেইজের বাঁধানো স্মারক উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক, প্রতিদিনের বাংলাদেশ চট্টগ্রামের ব্যুরো প্রধান এস এম রানা, বাংলাদেশ এস্ট্রোনোমিকাল এসোসিয়েশনের সভাপতি জিকরুল আহসান শাওন, প্রাক্তন ব্যাংকার ও শিক্ষক সুমিত্র সুজন, স্পোর্টিভ কোকোলোকোর কর্ণধার সাজিদুল হক,চট্টগ্রাম সরকারী কর্মাস কলেজের সাবেক জিএস ও  আওয়ামী লীগ নেতা খালেদ খান মাশুক প্রমুখ।

এর আগেও দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি, ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহর-গ্রামগঞ্জে ছোট ছোট সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন চট্টগ্রামের সৌখিন অ্যান্টিক সংগ্রাহক তারিকুল ইসলাম জুয়েল।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer