ছবি- সংগৃহীত
(পর্ব – ১ )
“বুচির মা,বুচির মা-বলি ওই আবাগীর বেটির কী এখনো ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়নি ? আমার গোপাল ভোগ পাবেন কখন”? বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে জানতে চাইলেন জমিদার গৃহিণী হেমাঙ্গিনী দেবী। তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। কাকপক্ষীদেরও ঘুম ভাঙেনি ঠিকমতো। হেমাঙ্গিনী দেবী বালাপোশটা গায়ে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুতে শুতে আবার হাঁক পাড়লেন
“বুচির মা? বলি কথা কানে যাচ্ছে না? এখনো ঘুম থেকে উঠিসনি নবাবজাদী? যেমন বাড়ির বৌ,তেমন হয়েছে এই হাড়বজ্জাত ঝি গুলি। একজন যদি কথা শুনে”?
এবারে বুচির মা ছুটে এল। দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতে এসেছে। গিন্নিমার আচরণে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বহুবার ভেবেছে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। কিন্তু লক্ষ্মী পিতিমার মতো দেখতে বৌদিদিকে এই ডাইনিবুড়ির কাছে রেখে যেতে প্রাণ কাঁদে। মানুষটা এত নরম যে বুড়ির অত্যাচারে অল্পদিনেই মরে যাবে। এইটুকু ভাবতেই বুচির মা মনে মনে বালাই ষাট বলে উঠল।
“বলি এই ভোরবেলায় এমন চেঁচাচ্চ কেন ? এই বাড়িতে যে গাছে কাকপক্ষীও বসে না তোমার চিৎকারের ঠেলায় তা জানো? তুমি বিছানা থেকে উঠোনি তাতে কোন কাজটা আটকে আচে শুনি ? বৌদিদির পুজো প্রায় হয়ে এয়েচে। গোপাল গোপাল করচ ,অথচ নিজেই এখনো বিছানা ছাড়োনি”! মুখরা বুচির মাকে হেমাঙ্গিনীও সমঝে চলেন। তবে জমিদার গৃহিনীর ডাঁটের কারণে সবসময় মনে রাখতে পারেন না। বৌটার ওপরে তিনি যে অত্যাচার করেন তার অনেককিছুর সাক্ষী এই বুচির মা।
“যা,যা এখান থেকে। আমার বয়েস আর ঐ মহারানির বয়স এক হলো ? ঐ বয়েসে আমিও করেছি। আমাকেও কেউ শান্তি দেয়নি”।
“এখন তার পিতিশোধ নিচ্ছ ? ধর্মে সইবে না গিন্নিমা এই আমি কয়ে রাখলুম”।
“সাতসকালে আমাকে জ্ঞানগম্যি দিতে হবে না। আমার জন্য জল গরম করে নিয়ে আয়”।
“এই কথা তো এমনিতে বলা যায়। ভোর বেলায় ,এখনো সূয্যি ওটেনি। ঘরের লক্ষ্মীকে গালমন্দ না করলে তোমার সকাল হয় নাকো ? তোমার নরকেও ঠাঁই হবে নাকো” গজগজ করতে করতে বুচির মা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
উনুনে জল চাপিয়ে দেয় হারু বৌদিদি ওঠার আগেই। যেদিন থেকে বুচির মা লক্ষ করেছে বারোমাস বৌদিদিকে এই পূজা করার জন্য সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হচ্ছে ,মাসের কয়েকটি দিন বাদে ,সেদিন থেকেই বুচির মা হারুকে বলে রেখেছিল বৌদিদির স্নানের জন্য এক ডেকচি জল বসিয়ে রাখতে। এমন একটা শান্তশিষ্ট বৌ এর সাথে কী আচরণটা করে বুড়ি! যমেরও অরুচি বুড়ি ভেবেই জিবে কামড় দিল। বৌদিদি বলেন মানুষের অমঙ্গল চাইতে নেই। আমরা যা ভাবি ভগবান সব জানতে পারেন। তাই যদি হয়,তাহলে ভগবান দেখতে পান না গিন্নিমা যে অকারণে বৌদিদিকে সবার সামনে অপমান করেন ? এ কেমন বিচার কে জানে ? মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমরা। তবে গিন্নিমা বেশি বাড়াবাড়ি করলে একদিন দাদাবাবুকে সে সব বলে দেবে।
গিন্নিমা গরমজলে ভালো করে স্নান করে যখন এসে উঠোনে চেয়ারে বসলেন আরাম করতে,তখন তাঁর ছেলেও এসে বসল অন্য চেয়ারে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়টার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। স্বর্ণ আধ গলা ঘোমটা টেনে দু কাপ চা এনে শাশুড়ি এবং স্বামীর সামনে রাখলেন। সূর্যশেখর বলতেন
“তোমার কাপটাও নিয়ে এসো স্বর্ণ” ?
হেমাঙ্গিনী দেবী ছেলেকে চোখের আগুনে ভস্ম করার পরিবর্তে বৌ এর দিকে এমন ভাবে তাকালেন মুনিঋষির মতো ক্ষমতা থাকলে স্বর্ণ ওখানেই ছাই হয়ে যেত। বৌ নিঃশব্দে ওখান থেকে চলে যেতেন। সকালবেলায় মা ছেলে একসাথে একপ্রস্থ চা খায়। সেখানে কখনো স্বর্ণের জায়গা হয় না। সূর্যশেখর মাঝে মাঝে প্রসঙ্গটা তোলে। কখনোই অনুমোদন পায়নি। বরং ছেলে যখন কোর্টে চলে যায় এরপর বৌকে ডেকে পাঠিয়ে বুড়ি তুলোধুনো করে। তাঁর ধারণা এটা মেনিমুখো বৌ এর কাজ। তা নইলে তাঁর ছেলের এত সাহস হয় একবার বারণ করার পর আবার একই কথা মায়ের সামনে তুলতে ? স্বর্ণ যত বলত “মা বিশ্বাস করুন আমি ওকে কখনো কিছু বলিনি”, হেমাঙ্গিনী দেবী কিছুতেই সেটি কানে তুলতেন না। একদিন সহ্য করতে না পেরে মুখরা বুচির মা বলে উঠল
“তা গিন্নিমা তুমি দাদাবাবুকে জিজ্ঞাসা করো না কেন বৌদিদিকে যখন বিশ্বাস করচ না” ?
“তুই থাম। বেশি কথা বলিস তুই ? কে এত সাহস দেয় তোকে শুনি”? বলেই তীর্যক দৃষ্টি হেনে বৌ এর দিকে তাকাতেন। স্বর্ণলতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতো আর দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করতো বুচির মায়ের কথার জন্য কোন্ শাস্তির খড়গ নেমে আসে ওর ওপর। এই হয়ে আসছে বহুদিন যাবত। অথচ যার কাছে সে অমূল্য ধন তাঁকে একবার বললেই হয়। কিন্তু স্বর্ণের রুচিতে বাধে ছেলের কাছে তাঁর মায়ের নামে কিছু বলতে। এছাড়া অন্য একটি কারণও রয়েছে। যেটির কথা মনে হলে ভয়ে স্বর্ণের বুক শুকিয়ে যায়!
সব কাজ সেরে রাতের স্বর্গভূমিতে যখন যায়,তখন স্বর্ণ তার এতটুকু সময় নষ্ট হতে দিতে চায় না। স্বর্ণলতা তাঁর নামের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্য দুবাহু দিয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরতো।ওটা একান্তই তার আর প্রিয় মানুষটির। আর কারও প্রবেশাধিকার নেই ওখানে। স্বর্ণ কাউকে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। সূর্যশেখর কত কী জিজ্ঞেস করতেন। শাশুড়ির বিষয় হলেই স্বর্ণ স্বামীর ঠোঁটে আঙ্গুল চাপা দেয় অথবা নিজের ঠোঁটজোড়া দিয়ে চেপে ধরে। স্বর্ণ জানে ওটা তাঁর স্বামীর জন্য মহৌষধ। সূর্যশেখর ঘাসে মুখ দিয়ে চলেন না। শহরের দুঁদে উকিল এইটুকু বুঝবেন না তাতো হয় না। তবে বৌ এর অধরের ছোঁয়া শরীরে অন্য রকম নাচন শুরু করে দেয়ায় কথা আর এগোত না।
স্বর্ণ ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসতো শাশুড়ির খনখনে কন্ঠস্বরে।
“সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছো যে ? আশকারা দিয়ে কাজের লোকদের মাথায় তুলেছ। আজ দুপুরে ভাত খেতে পারবে না আমার সূর্যের দিব্যি রইল। যাও আমার সুমুখ থেকে। ঝি চাকর দিয়ে আমাকে অপমান করানোর তেজ বার করাচ্ছি। আমিও জমিদারের বৌ। কী করে বৌকে ঢিট করতে হয় খুব ভালো জানি”।
স্বর্ণলতা খুব অবাক হতো না। ও এইরকম কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিল। নিঃশব্দে শাশুড়ির ঘর থেকে বের হয়ে চলে আসতো। এটাও শাশুড়ির পছন্দ হতো না। তিনি চাইতেন বৌ পায়ে পড়ে মাফ করার কথা বলুক। কিন্তু বৌ এর তেজ কম নয়। আজ অব্দি পারেনি বৌকে নোয়াতে। একদিন নিশ্চয়ই পারবে। তাহলে ওঁর বুকের ভিতরকার ক্ষত শুকাবে! তাঁর শাশুড়ি নিস্তারিণী দেবীর পায়ে তাঁকে কমবার পড়তে হয়নি। অন্যায় না করেও। তখনকার ঝি চাকরগুলি ছিল বুড়ির তাঁবেদার।
শাউড়িকে উল্টোপাল্টা লাগাত। আর হেমাঙ্গিনীও প্রথমদিকে শাশুড়ির সাথে তর্ক করত। অমনি সেদিনের জন্য ভাত বন্ধ করে দিত। এইরকম বার কয়েক শাস্তির পর আর মুখ খুলতো না। এছাড়া তাঁর ভাগ্যটা ছিল খারাপ। স্বামীর চরিত্র ভালো ছিল না। বাইরে কোথায় যেন যাতায়াত ছিল। হেমাঙ্গিনী শুনেছিলেন তাঁর শ্বশুরেরও একই দোষ ছিল। তাই শাশুড়ি এমন তিরিক্ষি মেজাজের ছিলেন। শ্বশুরের স্বভাবের মাশুল দিতে হতো বৌদের! তবে তাঁর পেটের ছেলে যে বৌ অন্তঃপ্রাণ এতে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। সেইজন্য বৌটিকে আরও সহ্য করতে পারতেন না।
স্বর্ণের সাথে যখন হেমাঙ্গিনী দেবী একই রকম আচরণ করতে শুরু করলেন, তখন থেকে বুচির মা দাদাবাবু কোর্টে যাওয়ার আগে জোর করে বৌদিদিমনিকে দুটো করে ভাত খাইয়ে দিত। কখন যে শাস্তির খড়গ নেমে আসে এই শান্ত বৌটির ওপর তার যে ঠিক নেই। আর স্বামীর দিব্যি দিলে কোন স্ত্রী খেতে সাহস করবে ? বৌদিমনি প্রথম প্রথম খেতে চাইতেন না।
একদিন বুচির মা সাফ জানিয়ে দিল সে দাদাবাবুকে জানিয়ে দেবে গিন্নিমার কথা। সেটি থামাতে স্বর্ণ রাজি হলো সকালবেলায় গরম ভাতে ঘি মিশিয়ে খেতে। আমিষ খেত না। কেননা শাশুড়ির জন্য রাঁধতে হতো। সকালে বাড়ির অন্যদের জন্য জলখাবার বুচির মাই বানাতো। ছুটির দিনে স্বর্ণলতাও হাত লাগাত। কিন্তু সেদিনও স্বর্ণের অনুমতি মিলত না স্বামী শাশুড়ির সাথে খেতে বসতে। বাচ্চারা তখন ছোটো ছিল। স্বর্ণ ওদের খাইয়ে দাইয়ে নিজে কিছু মুখে দিয়ে শাশুড়ির রান্নার তোড়জোড় করতে লেগে যেতেন।
হেমাঙ্গিনী দেবীর চার মেয়ের পর এই একটিমাত্র পুত্রসন্তান সূর্যশেখর রায়চৌধুরী। মাত্র ছয়মাস বয়েসে পিতা কিরণশেখর রায়চৌধুরীকে সূর্যশেখর হারিয়েছিলেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিরণশেখর। তৃতীয় মেয়ের বয়েস তখন পনের। তার বিয়ের কথাও শুরু হয়েছিল। এইসময় এক রাতের রক্তবমিতে তিন নাবালক সন্তানকে রেখে মারা যান। শরীরের ওপর কম অত্যাচার তো করেননি। তবে হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং বাবা ও দাদাদের ছায়া মাথার ওপরে থাকায় এত বড়ো জমিদারি খুব ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছিলেন।
’
হেমাঙ্গিনীর শ্বশুরবাড়ির জমিদারি ছিল মূলত খুলনায় বাবুপুর,কালিদাসপুর এবং বড়চানগর তালুক নিয়ে। খুলনা তখন ছিল যশোর জেলার মহকুমা ছিল। তবে কিরনশেখর রায়চৌধুরীর বেহিসাবী জীবনযাত্রার কারণে বড়চানগরের তালুক হাতছাআ জ্ঞাতিরা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। অনেক খুঁজে পেতে ছেলের জন্য বৌ এনেছিলেন একই মর্যাদার পরিবার থেকে। তবে ওঁদের অবস্থা তখন পড়তির দিকে। স্বর্ণলতা দেবীর গায়ের রঙ দেখেই তাঁর ঠাকুরমা এমন নাম রেখেছিলেন। আর গায়ের রঙের জোরেই এই বাড়িতে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল স্বর্ণলতা দেবীর।
শাশুড়ির আর বৌ এর গায়ের রঙের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছিল। শাশুড়ি মনে করতেন তিনি বেশি সুন্দরী। স্বর্ণের এই নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। রাতের শয্যায় স্বামীর আদর সামাল দেয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াতো ওর জন্য। ওদিকে ভোরে উঠতে হতো গোপালের পুজো দেয়ার জন্য। বুদ্ধি বিবেচনাবোধ খারাপ ছিল না স্বর্ণের। কিন্তু অহংকারী ও অত্যাচারী শাশুড়ির সামনে সেটি কখনো বিকশিত হওয়ার পথ খুজে পায়নি। (চলবে... )
অঞ্জনা দত্ত