Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

পৌষ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বিপ্রতীপ (পর্ব-৫)

অঞ্জনা দত্ত 

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

প্রিন্ট:

বিপ্রতীপ (পর্ব-৫)

ছবি- সংগৃহীত

(পূর্ব প্রকাশের পর)

“বাবা ,বাবা আসব”? 

“আয় বাবা। দেখে যা কী মানুষ নিয়ে ঘর করি”? 

“আমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আমি এই বাড়িতে থাকব না। তুমি মায়ের কাছে ক্ষমা না চাইলে”
 
“আমাকে মাফ করে দিন মা। আমার জন্য আপনাকে আজ সবার সামনে অপমানিত হতে হলো”। হিমাদ্রি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। 

“তোর আবার কী হলো ? তুই ভেউ ভেউ করছিস কেন”?  

“আমার জন্যই তো এমন হলো”। 

“যার জন্যই হয়ে থাকুক না কেন ,এই অচলায়তন ভাঙা প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। আগে করা যায়নি দেখে কোনোদিন করা হবে না তাতো নয়”।

স্বর্ণলতা কান্না ভুলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সূর্যশেখর কিছুক্ষণ তাঁর স্বর্ণময়ীর দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থেকে ছেলেকে বললেন

“বাবা তুই ভাইদের আর শ্বেতাকে দ্যাখ। আর রান্নাঘরে গিয়ে নয়নের মাকে বলে আয় রাতের খাবার ঠিকমতো ব্যবস্থা করতে। মা আজ এসব দেখতে পারবে না। বিয়ে করতে যাচ্ছিস। সব ব্যাপারে জ্ঞান থাকতে হয়”।
 
“ওকে কোথাও যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি”। 

“তুমি এই মুহূর্তে কোথাও যাবে না। ইনফ্যাক্ট আমি না বলা পর্যন্ত এই ঘর থেকে বের হবে না। আমার কথার বাইরে যাবে ? হিমু হাঁ করে কী শুনছিস”? 

“যাচ্ছি বাবা”। ও এতক্ষণ বাবা মায়ের কথা অবাক হয়ে শুনছিল। ওদের পরস্পরের মান অভিমান দেখছিল। ও কী পারবে শুচিস্মিতাকে এমন করে ভালোবাসতে ? আর শুচিস্মিতা ওকে ? আজকের ঘটনা নিয়ে কতরকমের গসিপ হবে এই বাড়িতে। হোক। ওর মন ভরে গেল প্রশান্তিতে মা বাবার ভালোবাসার সম্পর্ক দেখে। 
 
হঠাৎ করে বাড়িতে এমন একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যাওয়াতে কারও মনে ছিল না বারান্দায় আলো জ্বালানো হয়নি। অন্ধকারে বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে হিমাদ্রি হাঁটতে লাগল রান্নাঘরের দিকে। সবসময় মনের ভিতর কাঁটার মতো বিঁধত বাবা এমন নামকরা আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও মা নিগৃহীত হচ্ছে ঠাকুরমার কাছে ,অথচ বাবা কিছু বলেন না কেন ? খুব খারাপ লাগত। নিজেকে খুব ছোটো মনে হতো। আজ অন্তত এইটুকু পরিষ্কার হলো ওঁদের দুজনের মাঝে রয়েছে খুব সুন্দর সম্পর্ক। হিমাদ্রি খুশিতে যেন ভাসছিল। সম্বিত ফিরে পেলো যখন দেখল দুজন গাট্টাগোট্টা যুবক ওকে টেনে নিজেদের ঘরে ঢুকিয়ে ফেলল। অবাক হয়ে দেখল রাজ আর চাঁদ মিলে কাজটা করেছে। আর শ্বেতা মিটিমিটি হাসছে। 

“তোরা সবাই এখানে”?  

“তুমি বড়ো ছেলে হয়ে সব জানবে আর আমরা ছিঁটেফোঁটা কিছুই জানতে পারব না তা কী করে হয় ? ছাড়ো কিছু। বাবা কী বলেছে ? আর এটা তো নিত্যদিনের ঘটনা। আজ এমন কী হলো …”

“নিত্যদিনের একটা অন্যায় তো চিরদিন চলতে পারে না,তাই না? কী বলিস রাজ ? তুই তো একসময় ছাত্র রাজনীতি করতিস”।

“দাদা তুই আমাদের বলবি না”? 

“আমি সত্যিই ঠিক জানি না”।

“সেদিন তোর ঘরে গিয়ে মা এত কী কথা বললেন”? ফিক করে হেসে শ্বেতা জানতে চাইল। 

হিমাদ্রি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছোটো বোনের দিকে। ওরা কী গোয়ান্দাগিরি করছে ? কার ওপর ? মায়ের ওপর ? মনে মনে ভীষণ রাগ হলো পুচকে বোনের ওপর।  

“সে কথা তোকে বলতে হবে কেন”? বিরক্তিভাব না লুকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল।

দাদা এভাবে রিয়েক্ট করবে শ্বেতা ভাবতে পারেনি। ওর চোখ ছলছল করে উঠল। হিমাদ্রির খারাপ লাগল। এমন একটা কান্ড ওরা জানতে চাইতেই পারে। ও গিয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহার্দ্র স্বরে বলল 

“বোন আমরা এতগুলো মানুষ এই পরিবারে আছি। মা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, বড়ো করেছেন। কোনোদিন আমরা কেউ তাঁর কাছে কিছু জানতে চেয়েছি কেন ঠাকুরমা এমন আচরণ করেন তাঁর সাথে? যিনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের জন্য,কে কোন খাবার খেতে ভালোবাসে … আমরা জানি মা কী খেতে ভালোবাসেন? মা যে আমাদের সাথে খেতে না বসে নয়নের মা,শেফালি,হারু এদের নিয়ে খেতে বসেন একবার বলেছি মা তুমি আমাদের সাথে খেতে বসো? আমরা নিজেরাই মাকে কোন গোত্রে ফেলেছি একবারও ভাবিনি”। হিমাদ্রির কন্ঠস্বর বিষন্ন শোনালো।

“আমি তো বুদ্ধি হয়েছে থেকে এই দেখে আসছি”। চিঁ চিঁ করে বলল শ্বেতা। 

“আমি শুধু তোর কথা বলছি না। আমাদের সবার কথা বলছি। আমিও তো  জানতে চাইনি। মার কথা ভাবিনি। যত বড়ো হচ্ছিলাম ঠাকুরমার আচরণে রাগ হতো। কিন্তু বাবাকে নিস্পৃহ মনে হতো দেখে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেতাম। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারিনি। আজ এতদিনকার পুঞ্জিভূত মেঘ বজ্রাকারে ফেটে পড়েছে। আর মা বলছেন বাবাকে ঠাকুরমার কাছে ক্ষমা চাইতে”।

“মা বলছেন”? চাঁদ আর্তনাদ করে উঠল।  

“তাহলে আজ মায়ে ছেলে যুদ্ধ হয়েছে? আমাদের মাকে নিয়ে”? রাজশেখর জানতে চাইল। 

“লেগেছে তো বাবার সাথে। তবে ঠিক কী নিয়ে বলতে পারব না”। 

“তুই যে গেলি তোকে বাবা কিছু জানাল না”? চাঁদ দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়।  

“না। ওহো বাবা আমাকে একটা কাজ দিয়েছিল। তোদের গোয়েন্দাগিরিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি যাই”।

“কোথায় দাদা” ? 

“রান্নার পিসিকে বলতে রাতে কী রাঁধতে হবে”। 

“সেকি ? মা আর রাঁধবেন না”?  

“তা জানি না। তবে আজকের রাতের মতো মা বাবার অনুমতি ছাড়া রান্নাঘরে যেতে পারছেন না”। 

ভাইয়েরা আর শ্বেতা বড়ো বড়ো চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা বাবাকে রাশভারি বলেই জানত। সহজে বাবার কাছে ঘেঁষত না। যত আবদার ঠাকুরমার কাছে ছিল। মা ছিলেন নিতান্তই সুস্বাদু খাবারদাবারের জোগানদার। অসুখে বিসুখে সেবা করা। ওদের কাপড়চোপড় ধোপাবাড়িতে পাঠানো ,ইস্ত্রি হয়ে এলে হারুকে দিয়ে যার যার ঘরে পৌঁছে দেয়া। শুধু শ্বেতার কাপড় নিজের হাতে ধুতেন অথবা ধোপাবাড়ি থেকে এলে পরে নিজেই ওর ঘরে নিয়ে যেতেন। 

স্বল্পভাষী চাঁদ বলল   

“বাবাকে প্রণাম জানাই। এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করেছেন। আর আমাদের সবার মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত”। 

“চল যাই”। রাজ বলল।

“পরে যাস। এখন ওঁরা দুজনে সময় কাটাচ্ছেন। তবে এবার থেকে একটা কাজ করতে পারি মাকে জোর করে আমাদের সাথে খেতে বসাতে হবে”।

“সেতো রাত ছাড়া হবে না। দিনের বেলায় আমরা তো নিজেরাই যে যার সময়মতো খাই”।

“হোক রাতের বেলায়। সমস্যা কোথায়”? 
 
“ঠিক। এটাই করতে হবে”। চার ভাইবোন সমস্বরে বলে উঠলো।  ( চলবে...)

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer