Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

কার্তিক ১৫ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪

দেশ ছেড়েছেন ‘ছাগলকাণ্ডে’র মতিউর: এনবিআরের পদ হারালেন

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:২২, ২৪ জুন ২০২৪

প্রিন্ট:

দেশ ছেড়েছেন ‘ছাগলকাণ্ডে’র মতিউর: এনবিআরের পদ হারালেন

ফাইল ছবি

ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর বিভিন্ন বাসভবনে খোঁজ নিয়েও সন্ধান মেলেনি। এমনকি কোরবানির ঈদের ছুটির পর অফিস খুললেও তিনি আর অফিসে আসেননি। এই সময়ে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি দেশ ছাড়ার সব প্রস্তুতি সেরেছেন।

রোববার বিকেলের দিকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মতিউর পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা। এর আগে গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করতে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে। একই দিনে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। হারিয়েছেন তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও।

সব হারানোর পেছনে রয়েছে ‘ছাগলকাণ্ড’। ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ১৫ লাখ টাকার ‘ছাগল কেনা’ ইস্যুতে তোপের মুখে পড়েন মতিউর। ইফাতের ছাগল কেনার বিষয়টি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর পরই তা ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়।

শুধু তাই নয়, বেরিয়ে আসে এই কর্মকর্তা ও তাঁর পরিবারের অঢেল সম্পদের চিত্র।মতিউরের ঘনিষ্ঠ কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর মতিউর রহমান ভারত থেকে সরাসরি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট তাঁকে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছে।

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অল্প সময়ে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় তিনি আতঙ্কে ছিলেন।

কারণ তাঁর চেহারা সবার পরিচিত। তবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের পরামর্শে তিনি মাথার চুল ফেলে টাক হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। মূলত সবার কাছ থেকে চেহারা আড়াল করতে এই কৌশলের আশ্রয় নেন তিনি।

এর আগে ধানমণ্ডি, কাকরাইল, গুলশানসহ মতিউরের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের ঠিকানায় বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে কোথাও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর তাঁকে অফিস করতেও দেখা যায়নি। মূলত এর পর থেকেই দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘মতিউর এখন কোথায়?’

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ছাগলকাণ্ডের পর ছেলেকে অস্বীকার করে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গাঢাকা দিয়েছিলেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। মুঠোফোনে যোগাযোগও ছিল সীমিত। সেই সময়ে অস্বীকার করা ছেলেকে নিরাপদে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে পড়াশোনা করা মতিউর রহমান অনেক কম্পানির ছায়া পরিচালক। একাধিক ছোট কম্পানি শেয়ারবাজারে আনার মাধ্যমে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িতদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

এনবিআরের পদ হারালেন

ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।

জানা গেছে, মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তাঁর। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের কমিশনার হিসেবে। সেই সময় বিভিন্ন কম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের জন্য এনবিআর ও দুদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে রহস্যজনক কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থা দুটি।

সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণ

সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে ছিলেন মতিউর রহমান। তবে ছাগলকাণ্ডে সমালোচিত হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্ষদ সভা শেষে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘পরিচালক সরকারি পোস্ট। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি ইস্যু না করলে চূড়ান্ত অপসারণ হবে না। তবে মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে, তাঁকে সরানো হবে। আমাদের সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অপসারণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যুর পর। তবে এখন থেকে মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের কোনো সভায় থাকতে পারবেন না।’

নামে-বেনামে যত সম্পদ

মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী, পাঁচ সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে গড়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এরই মধ্যে দেশেই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের হদিস মিলেছে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, রিসোর্ট রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে নিজ নামে অর্ধশত কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। ছাগলকাণ্ডে আলোচিত পুত্রকেও কিনে দিয়েছিলেন প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো চারটি বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি তাঁর বিভিন্ন কম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। কিনে দিয়েছেন দামি পাখিও। তাঁর পরিচিত কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, বেনামে এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকাতেই অন্তত দুই ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে। সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সেখানেই প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের হদিস পাওয়া গেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তাঁর আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইনগত ঝামেলা এড়াতে নিজের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন মতিউর রহমান। টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামের ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা রয়েছে তাঁর। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তাঁর ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে গ্লোবাল শুজ নামের দুটি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছেন তাঁর ছেলে ও মেয়ে। এ ছাড়া পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিকও তিনি।

গাজীপুর সদর এলাকায় ১৭১ নম্বর এসএ দাগে ১০.৫০ শতাংশ, ১৭২ নম্বর এসএ দাগে ৩.৯০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭.৫০ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৭০ নম্বর এসএ দাগে ৬ শতাংশ, ১৬৩ নম্বর এসএ দাগে ৭ শতাংশ এবং ১৭০ নম্বর দাগে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে। এ ছাড়া সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩০৩৫, ১৭৬৩ ও ১৭৬২ নম্বর দাগে ১২.৫৮ শতাংশ জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এই আটটি খতিয়ানে রয়েছে তাঁর ৬০ শতাংশ জমি। স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৩৬৯৬ নম্বর এসএ দাগে ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুরে ৪৮.১৬ ও ১৪.৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ০.৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer