![স্মরণ: প্রেরণাদাতা আপদামস্তক এক শিক্ষক মোহসীন স্যার স্মরণ: প্রেরণাদাতা আপদামস্তক এক শিক্ষক মোহসীন স্যার](https://www.bahumatrik.com/media/imgAll/2018September/Mohsin20210719040649.jpg)
-অধ্যাপক এ. কে. এম. মোহসীন
কভিড-১৯ আমাদের অনেক স্বজন-প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে। এ. কে. এম. মোহসীন (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক) ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) তাদের একজন। তিনি শুধু আমাদের শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন অনুপ্রেরণা দাতাও।
১৯৭৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ ভর্তি হলাম। এইচএসসিতে ইসলামের ইতিহাস পড়েছি। তাই ইতিহাস পড়তে তেমন কষ্ট হয়নি। আমরা কোর্স পদ্ধতির ৩য় ব্যাচ। আজকের মতো শিক্ষার্থীদের অনেক পেপার তখন পড়তে হতো না। তিন বছরের অনার্সে মোট ৯০০ নম্বরের অনার্স পরীক্ষায় ১০০ ছিল প্রথম বর্ষে। আর সঙ্গে সাবসিডিয়ারি ২টি বিষয়ের ২০০ নম্বর। প্রথম বর্ষ অনার্সে ৫৭ নম্বর পেলাম। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠে তাই আরো সিরিয়াস হলাম।
২য় বর্ষে ইনকোর্সের নম্বরে প্রায় ৬৩%-৬৪% পেলাম। দ্বিতীয় বর্ষে ২টি পেপার। একটি মোগল ও আধুনিক ভারত অন্যটি ইসলামের ইতিহাস। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া পড়াতেন প্রফেসর ড. কে. এম. মোহসীন। স্যার এ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। তাই খান মোহাম্মদ মোহসীন নাম ব্যবহার তেমন হতো না। আমার সহপাঠী মতিয়ার (মতিয়ার রহমান, অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি) স্যারের এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। সেই সুবাদে স্যারের বেশি পরিচিত। স্যার একদিন মতিয়ারকে দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আগেই মতিয়ারের কাছ থেকে জেনেছিলাম ভয়ের কোন কারণ নেই। পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু একটা বলতে চান স্যার।
কয়েকদিন পর মতিয়ার আর আমি স্যারের চেম্বারে উপস্থিত হলাম। স্যার আমার আর মতিয়ারের ইনকোর্সের খাতা বের করলেন। আমাদের দু’জনের উত্তর ভালো হয়েছে জানালেন। আমাকে বললেন তুমি বেশি লিখতে পারো এবং ইতিহাসের ছাত্রের জন্য এটি একটি ভালো গুণ। পরে আমাকে এই পত্রের জন্য ২টি বই লাইব্রেরি থেকে তুলে দিলেন। কয়েকটি নোট করেও স্যারকে দেখাতে বললেন। এভাবে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হলো। স্যারের প্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিল পলাশির যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণ, ফলাফল নিয়ে তিনি খানিকটা বেশি সময় নিতেন।
এখনো তাঁর সেই লেকচার আমার কাছে আছে। পেছনে বসলে স্যারের কথা কম শোনা যেতো বিবেচনায় সকলে ক্লাস শুরুর আগে ক্লাসে আগের সিট দখল করে নিতো। স্যার যেহেতু ধমক দিতে পারতেন না, রাগতেন না তাই আমাদের মধ্যে ফাঁকিবাজ বন্ধুরা পিছনে বসে দেদার ব্যক্তিগত আলাপ, প্রেমের সাফল্য ব্যর্থতা এসব আলোচনা করার সুযোগ নিতো। ২/১ বার স্যার ধমক দিলেও তার তরঙ্গ প্রবাহ ক্ষীণ থাকায় পেছনে পৌঁছে রাগের মাত্রা আরো কমে যেতো। স্যারের ক্লাসে আরো একটা গুণ ছিল মাঝে মাঝে হাস্যরসাত্বক গল্প করতেন। যে কারণে ইতিহাসের কঠিন সব ঘটনা সন-তারিখ মনে গেঁথে যেতো। কোর্স ফাইনাল পরীক্ষার পর দ্বিতীয় বর্ষের ফল বের হলে স্যারের কোর্সে ৬৩ নম্বর পাই। আমাদের সময় ইতিহাসে ৬০% নম্বর পাওয়া বেশ কষ্টকর ছিল। ফল জানাতে স্যারের কাছে হাজির হলে স্যার ভীষণ খুশি হলেন। সেবার অন্য পত্রে আমি ৬৪ পাই। এক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের ৫৭, স্যারের পত্রে কাভার হয়ে যায়। অর্থাৎ আমি দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম বর্ষের প্রথম শ্রেণির কম ৩ নম্বর কাভার করে মোটের দিক থেকে ৪ নম্বর বেশি পাই। দ্বিতীয় বর্ষ আমার ছাত্র জীবনের অনেক কিছু বদলে দেয় যার মূল প্রেরণা মোহসীন স্যার।
তৃতীয় বর্ষে স্যারের কোন কোর্স আমাদের সঙ্গে না থাকলেও যোগাযোগ মাঝে মধ্যে হতো। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল মতিয়ার। স্যার এস. এম হলে প্রভোস্ট এবং মতিয়ার সে হলের ছাত্র হওয়ায় ২/১ বার হলেও স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা হলে অন্তত: ৩ মাস সময় পাওয়া যেতো রেজাল্টের জন্য। বেকার বসে আছি। স্যার একদিন মতিয়ার আর আমাকে ডাকলেন। স্যার তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্পের পরিচালক। সম্ভবত: ১৯৮৪ সাল। স্যার আমাদের সেই প্রকল্পের সেগুনবাগিচা অফিসে যেতে বললেন। আমাদের উৎসাহের বিষয় যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ তাই দু’জন একদিন গিয়ে উপস্থিত হলাম। প্রকল্পের ছোট অফিস। গবেষক হিসেবে ছিলেন ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী, শাহ আহমদ রেজা, ওয়াহিদুল হক। সকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র। সেদিনই স্যার আমাদের কাজে লাগিয়ে দিলেন। প্রকল্পে জমাকৃত কিছু কিছু লেখা স্যারের নির্দেশিত পথে পড়তে শুরু করলাম। সঙ্গে আলমারিতে সংগ্রহ দেশ-বিদেশের মুক্তিযুদ্ধের বই। মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন পুস্তিকাও ছিল। আমার পাঠক ও লেখক জীবনের সূত্রপাত ধরতে গেলে তখন।
১৯৮৫ সালে আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী (এপ্রিল, ১৯৮৫) বই বের হলো। প্রকল্প থেকে বহু তথ্য পেয়েছিলাম। আমি যে বইটি পড়তাম সেটা একটা ছোট খাতায় বিবরণসহ লিখে রাখতাম। এক সময় মনে হলো যে বইটি পড়িনি সেটাও আলাদা তালিকা রাখলে ভালো হয়। ইতোমধ্যে অনার্সের পরীক্ষা ফল বের হলো। আমি দ্বিতীয় এবং মতিয়ার তৃতীয় হলো। স্নাতকোত্তর ক্লাসের চাপে কিছুটা বিরতি হলেও আবার পরীক্ষার পর বই পড়া ও প্রকল্পে যাওয়া আসা শুরু করলাম। কখনো কখনো স্যারের উপস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয় জানার চেষ্টা করতাম। স্যার আমাদের আগ্রহ দেখে দলিলপত্রের ২টি খ-ের (৮, ১৫) নির্ঘণ্ট করতে দেন। এর ফলে ২টি বইয়ের আদন্ত পড়তে হলো। জীবনের প্রথম রোজগার ১০০০ টাকা পেলাম। মতিয়ার পেলো ১০০০। প্রথম রোজগারের আনন্দ ভুলবার নয়। আর তখন ১০০০ টাকা অনেক টাকা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ১৫ খ-ের দাম ছিল ২০০০ টাকা। পরে নিজেও অন্যের বইয়ের নির্ঘণ্ট করে দিয়েছি হাতে কলমে যার শিক্ষা পেয়েছি মোহসীন স্যারের কাছ থেকে।
অনার্স ফলের পর আমার মাথায় নতুন একটি পোঁকা ঢুকে। আমি অনার্সে সূর্যসেন হলে সংযুক্ত ছিলাম। বাসা থেকে ক্লাস করতাম বিধায় হলের খাবার, বিখ্যাত পাতলা ডাল সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে হয়নি। দু’একজন ঐতিহ্য পূজারী পরামর্শ দিলেন আমার মতো ভালো ছাত্ররা একদা জামাই খ্যাত সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র ছিলেন। জামাই হওয়ার যোগ্যতা তখনো না হলেও মাথার পোঁকাটি নড়াচড়া করতে থাকে। সলিমুল্লাহ হলে মাস্টার্সে সংযুক্ত হওয়ার আকর্ষণ ছিল স্যার তখন প্রভোস্ট, আর মতিয়ার সে হলের আবাসিক ছাত্র। তখন আমার বিভাগের নাজিম ভাই (নাজিমুদ্দিন চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত সচিব) হলের আবাসিক ছাত্র। নোট আনতে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যাওয়া হতো। আমার বিবেচনায় সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ হল। একদিন স্যারের শরণাপন্ন হলাম, সঙ্গে তদবিরকারী মতিয়ার।
স্যারের সরাসরি জবাব হলে সিট চাইলে নিবো না। অনাবাসিক হলে ঠিক আছে। মতিয়ার বলে স্যার দেলোয়ারের মোহাম্মদপুরে বাসা, সিটের দরকার নেই। স্যার সম্মতি দিলে আমি এম.এ. ক্লাসে সূর্যসেন হল থেকে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হলাম। স্যারের সুবাদে এরপর মাস্টার্স এর পর এম ফিল কোর্সেও সেই হলে সংযুক্ত হয়েছি। আমাকে সলিমুল্লাহ হল আর ছাড়েনি। ১৯৮৫-২০০১ সাল পর্যন্ত এ হলের সঙ্গে আস্টে পিস্টে বাঁধা পড়লাম। এর মধ্যে ১৯৮৫-১৯৯০ পর্যন্ত ছাত্র হিসেবে এবং ১৯৯০-২০০১ পর্যন্ত সংযুক্ত শিক্ষক হিসেবে। এম.ফিল. ছাত্র থাকাকালীন আমি শিক্ষক হয়েছি। তখন ডাকসুর নির্বাচনে এম.ফিল ছাত্র হিসেবে ভোট দিতে পারতাম। আমি ছাত্র না হয়ে শিক্ষক হিসেবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করি। ২০০১ সালে শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে হাউস টিউটর হয়ে সলিমুল্লাহ হল থেকে আমার নাম কাটা যায়। আর ২০১০ সালে এ হলের প্রভোস্ট হয়ে সংযুক্ত শিক্ষক হিসেবে স্থায়ী হই। গেলো ডাকসু নির্বাচনে চিঠি পেলাম আমি শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক। দায়িত্ব কিছু ছিল না, নির্বাচন দেখতে গিয়েছিলাম।
এর মধ্যে আবার বিরতি ঘটলো। ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিলাম। পরের বছরেই বিসিএস (প্রশাসন), ১৯৮৫ ব্যাচ (সপ্তম বিসিএস) ক্যাডারে মনোনীত হলাম। মতিয়ার আগের (১৯৮৪) ব্যাচ বিসিএস (পুলিশ) এ যোগ দিয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা আমাকে বেশি আকর্ষণ করলো। এর প্রধান কারণ মুক্তিযুদ্ধ এবং স্যারের প্রেরণা। শিক্ষকতা বেছে নেয়ার পেছনে যে কয়জনের উৎসাহ ছিল স্যার তাদের অন্যতম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাকী জীবনের সঙ্গী হলো আবার লাইব্রেরির মুক্তিযুদ্ধের বই। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্পের প্রায় ৪০০ বইয়ের তালিকা খাতায় লিখে রেখেছিলাম সেটার সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় মুসলিম লাইব্রেরির বইয়ের তালিকা যুক্ত করে এক সময় প্রায় ৬০০ এর মতো বইয়ের তালিকা হলো। দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার বইয়ের পাতায় গ্রন্থ সমালোচনা লেখার সুবাদে আরো কিছু বই পেয়ে পেলাম। মোহসীন স্যার বিষয়টি জানতেন। স্যার এবং বাংলা বিভাগে আমার সহকর্মী ড. ভূঁইয়া ইকবাল আরো কিছু তালিকা করে মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের একটি গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ণের উপদেশ দেন। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য লাইব্রেরি থেকে সংগৃহীত তালিকার ভিত্তিতে একটি পা-ুলিপি তৈরি করি।
১৯৯১ সালে আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি বই প্রকাশিত হয়। এতে ৮৩৫টি মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের তালিকা ছিল। এ বইটির তৃতীয় সংস্করণ ২০১৪-তে প্রায় ৫০০০ বইয়ের তালিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বের করে। চতুর্থ সংস্করণ এবছরই বের হবে যাতে প্রায় ৮০০০ বইয়ের তালিকা থাকবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি নামে বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৪ সালে যে বই বের হয়েছে সেখানে ৯০০ বইয়ের তালিকা আছে। একাডেমি এবছর এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের করছে যাতে প্রায় ২৩০০ বইয়ের তালিকা থাকছে। এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন এবং গবেষকদের সহযোগিতা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার পেছনে আমার গুরু নিঃসন্দেহে মোহসীন স্যার।
স্যার একটি কথা বলতেন গবেষণার আগে বিষয় সংশ্লিষ্ট গ্রন্থপঞ্জি তৈরি করতে হবে। এতে সেই বিষয়ের যে যে কাজ হয়েছে তা বের হয়ে আসবে। আর নিজের গবেষণাও এর তথ্য উপাত্ত নিয়ে সমৃদ্ধ হবে। স্যারকে এ বইগুলোর সৌজন্য কপি বহুবার দেয়া হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয় গ্রন্থপঞ্জি যতোটুকু মনে পড়ে ৩/৪ বার দিতে হয়েছে। কোনো কাজের জন্য বইটি দেখতে হলে স্যার খুঁজে না পেলে আবার ফোন করতেন বইটি দেওয়ার জন্য। শেষে ঠাট্টা করে একবার বলেছিলাম স্যার এবারই শেষ, ভালো করে রাখবেন। আমাদের উভয়ের প্রিয় ছাত্র ড. হাবিবুল্লাহ বাহার ২/১ বার এই বই লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার কাছ থেকেও শুনেছি স্যার বই হারিয়ে ফেলেন কিংবা কেউ নিয়ে যায় তাই তার কাছ থেকেও একাধিকবার একই বই স্যার নিয়েছেন।
২০১৪ সালে আমি যখন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখালেখির জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলাম স্যার ভীষণ খুশি। ফোনে অভিনন্দন জানালেন। আমি বলতে ভুলিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার জন্য যেই প্রেরণা পেয়েছি তার হাতে খড়ি স্যারের কাছে। স্যার অবসর গ্রহণ করে উত্তরা চলে যান। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকায় যোগাযোগ কমে যায়। মাঝে স্যারের ফোন পেয়েছিলাম। স্যারকে নিয়ে কারা যেনো একটি বই করবে সেখানে একটি লেখা দিতে হবে। স্যারের কোন তাগিদ না পাওয়ার ভুলেই গিয়েছিলাম। স্যারের খবর পাওয়ার মাধ্যম ছিল ড. হাবিবুল্লাহ বাহার। মৃত্যুর দিন ১০ আগে সেই জানালো স্যার হাসপাতালে ভর্তি এবং অবস্থা ভালো না। করোনা এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্যারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল না। তারপরও বিভিন্ন জন চিকিৎসা শেষে ফিরে এসেছেন এমন আশা স্যারের ব্যাপারে আমারও ছিল। কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি (২০২১) সে আশা নিরাশায় পরিণত হলো। স্যার চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে গেলেন।
মোহসীন স্যার আমাদের মাঝে না থাকলেও তার কীর্তি, অমায়িক ব্যবহার, আপাদমস্তক শিক্ষকসূলভ আচরণ শুধু তাঁর ছাত্র, সহকর্মীদের নয়, যারা তাঁকে জানতেন তাদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি যে সকলের প্রিয় ছিলেন জানাজার সময় তা উপলব্ধি করেছি। করোনার মধ্যেও বহু লোক জানাজায় অংশ নিয়েছেন। স্যারের পরিচিতির সীমাও ছিল অসীম।
মাঝে মাঝে মনে হতো মানুষ মাত্র একবার হলেও রেগে যান। স্যারকে কখনো রাগতে দেখিনি। স্যারকে কেউ কেউ কখনো রাগাতে চেয়েছেন তা দেখেছি, কিন্তু স্যার অনড়। স্যারের ছেলে অমি জানাজার সময় একই কথা বললেন। তারাও পিতা হিসেবে কখনো বাসায় বা বাইরে স্যারকে রাগতে দেখেননি। কাউকে কথায় বা কাজে কষ্ট দেননি। আমার গবেষক জীবনের শুরুতে তাঁর যে অনুপ্রেরণা, শিক্ষা তা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক করেছে। আজ এ বিষয় লেখালেখির জন্য অনেকে আমাকে চেনে এর পেছনে রয়েছে স্যারের অবদান।
স্যারকে কথা দিয়েছিলাম স্যার সম্পর্কে একটা লেখা দিবো। স্যারের হাতে লেখাটা দেওয়া হলো না। নিজকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে। তখন লিখলে আরো বেশি লিখতে পারতাম। এখনতো এর চেয়ে বেশি আর পারবো না। ক্ষমা চাই স্যারের কাছে জীবিতাবস্থায় কথা দিয়েও সময় মতো তার কাছে লেখা দিতে পারিনি। স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা আর আত্মার প্রশান্তি কামনা।
লেখক: চেয়ারম্যান, ইতিহাস বিভাগ, ডিন, কলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বহুমাত্রিক.কম