
ফাইল ছবি
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে ব্লিচিং বা রং হারানোর কবলে পড়েছে বিশ্বের প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর। এতে প্রবালগুলো মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সময় বুধবার আন্তর্জাতিক প্রবাল প্রাচীর উদ্যোগ (আইসিআরআই) এটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে বড় প্রবাল ব্লিচিংয়ের ঘটনা বলে অভিহিত করেছে ।
২০২৩ সালের বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কোরাল ব্লিচিং বা সামুদ্রিক শৈবালের রং হারানোর এই সংকট শুরু হয়, যা চলতি বছরে তীব্র আকার ধারণ করেছে। মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) খবরে এমন বলা হয়েছে।
আইসিআরআইয়ের তথ্যমতে, এ নিয়ে চতুর্থ বারের মতো প্রবাল ব্লিচিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। আশির দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে ঝুঁকির বিষয়টি লক্ষ করা যায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
পর্যবেক্ষণের তথ্যাদি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে সারা বিশ্বের সব প্রবালপ্রাচীর ব্লিচের শিকার হয়। এরপর ২০১৪-১৭ সাল নাগাদ বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ প্রবালপ্রাচীর রং হারায়। ওই ঘটনার পর সাম্পতিক সময়ে ভয়াবহ আকারে আবার শুরু হয়েছে প্রবাল ব্লিচিং।
আন্তর্জাতিক প্রবালপ্রাচীর সোসাইটির নির্বাহী সম্পাদক ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সামুদ্রিক ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসনের প্রধান পর্যবেক্ষক মার্ক একিন বলেন, ‘তাপদাহের কারণে সামুদ্রিক প্রবালের রং হারানোর ঘটনায় বিশ্বব্যাপী এমন সংকট তৈরি হতে এর আগে কখনোই দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি যা পৃথিবীর চেহারাই বদলে দেবে। শুধু তাই নয়, এটি সামুদ্রিক জীব ও তাদের জীবিকার সক্ষমতাকেও বদলে দেবে।’
২০২৪ সালটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের উষ্ণতম বছর। এই তাপগুলো সব সমুদ্রে চলে গেছে বলে জানান মার্ক। এতে মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল হচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। এজন্য একে সমুদ্রের রেইন ফরেস্টও বলা হয়। এছাড়া সামুদ্রিক খাদ্য উৎপাদন, পর্যটন, উপকূলকে ক্ষয় ও ঝড় থেকে রক্ষা করতেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে প্রবালপ্রাচীর।
গবেষকদের তথ্যমতে, প্রবাল একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সীমার মধ্যে সক্রিয় থাকে। প্রবালের উজ্জল রংয়ের কারণ তার ভেতরে থাকা রঙিন শৈবাল। এটি প্রবালগুলোর খাবারেরওে উৎস। তবে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে প্রবালের রং ও পুষ্টির উৎস ক্ষুদ্র সেই শৈবালগুলো ভেতর থেকে বের হয়ে যায়। আর তাই তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে প্রবালপ্রাচীর একপর্যায়ে সাদা হয়ে যায়। এতে প্রবালগুলো মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: দাবানল কী ও কেন হয়? পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ানক কয়েকটি দাবানল
অনেকদিন ধরে চলমান এই ব্লিচের কবলে পড়েছে অষ্ট্রেলিয়ার অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম প্রবালপ্রাচীর ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফটিও’। বিগত নয় বছরের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বড় ব্লিচের ঘটনা ঘটেছে বলে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে।\
অস্ট্রেলিয়ার ইনস্টিটিউড অব মেরিন সায়েন্স ও গ্লোবাল কোরাল রিফ মনিটরিং নেটওয়ার্কের (জিসিআরএমএন) পর্যবেক্ষক ড, ব্রিটা শ্যাফেল বলেন, ‘এর আগে কখনো এমন সংকটের মুখে পড়েনি প্রবালপ্রাচীর।’
তিনি বলেন, ‘যারা নিজেদের পুরো জীবন এসব প্রবালের দেখাশোনা ও সুরক্ষার জন্য ব্যয় করেছেন তাদের জন্য এটি খুবই হতাশাজনক। বাস্তুতান্ত্রিক ক্ষতির বিষয়ে এই কষ্ট বাস্তব। যারা পানির নিচে এসব শৈবালের পর্যবেক্ষণে থাকেন, তারা চোখের সামনেই এই পরিবর্তন হতে দেখছে।’
এদিকে, প্রবাল সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে জানানো হয়েছে এপির প্রতিবেদনে। সিচেলিস উপকূলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা প্রবালের টুকরো নিয়ে সেগুলাকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে (জু) বংশবিস্তার করানোর চেষ্টা করছে নেদারল্যান্ডসের একটি গবেষণাগার।
অন্যদিকে ফ্লোরিডার কাছে আরেকটি প্রকল্পে অতিরিক্ত তাপে বিপন্ন প্রবালগুলোকে উদ্ধার করে সেগুলোকে সুস্থ করে তোলার পর আবার সমুদ্রে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তবে এই সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
মার্ক বলেন, প্রবাল প্রাচীর রক্ষার সবথেকে ভালো উপায় হলো জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করা। জীবাশ্ম জ্বালানীর পোড়ানো বন্ধ করে ক্ষতিকর গ্যাসগুলোর নির্গমন বন্ধ না করা হলে অন্য কোনো সমাধানই স্থায়ী হবে না বলে মত দেন তিনি।
জিসিআরএমএনের ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের স্টিয়ারিং কমিটির গবেষক মেলাইন ম্যাকফিল্ড বলেন, মানুষকে বুঝতে হবে তারা আসলে কি করছেন। মানুষের কর্মকান্ডের ফলে রং হারিয়ে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়া প্রবালগুলো ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেন তিনি।
এমন এক সময়ে এই তথ্যগুলো সামনে এসেছে, যখন দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার প্রত্যাহার করে জীবাশ্ম জ্বালানীর পোড়ানো বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটাতে চাইছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গবেষক মার্ক বলেন, ‘আমরা এমন এক সরকার পেয়েছি, যারা বাস্ত্রসংস্থান ধ্বংস করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। তবে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে চলেছে।’-ইউএনবি নিউজ