ঢাকা: ‘সনাতন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অনাদি, অনস্ত, চিরস্থায়ী, শাশ্বত ইত্যাদি। অর্থাৎ যে ধর্ম প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে তাকেই সনাতন ধর্ম বলে। ঐতিহাসিকদের ধারণামতে আজ থেকে ৫ হাজার বছর পূর্বে সনাতন ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু সনাতন ধর্মের প-িতরা মনে করেন আজ থেকে ১০ হাজার বছর পূর্বে সনাতন ধর্মের আবির্ভাব। উদ্ভব নিয়ে মতৈক্য থাকলেও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে প্রকৃতি রক্ষার্থে সনাতন ধর্মের বিধি-নিষেধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বেদের মতে প্রকৃতিই ঈশ্বর।
আবার বলা হয়েছে, “জীব আত্মায় পরম আত্মা”। সনাতন ধর্মের মহাপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন-“যত্র জীব তত্র শিব”। সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন-“জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” জীব অর্থ এখানে শুধু মানুষকে বোঝানো হয়নি। বোঝানো হয়েছে যার মধ্যে প্রাণ আছে সে-ই জীব। গাছের প্রাণ আছে; গাছ মানুষের উপাস্য হতে পারে। উপাস্য হতে পারে গরু, ছাগল, সাপ, শূকর ইত্যাদি। এ ধর্মে জীবের আরাধনা শিব হিসেবে করার বিধান রয়েছে।
প্রকৃতির সাথে সনাতন ধর্মের গভীর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর ভগবানের অবতার তত্ত্বে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবী সৃষ্টি নিয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর হিন্দু পুরাণের দশ অবতারের তত্ত্বের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। যদিও ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটি ভিন্ন বিষয়।
বিজ্ঞান শুধুমাত্র জড়জাগতিক বিষয় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। ধর্ম জড় ও চিন্ময় উভয় জগতের বিষয়ে ব্যাখ্যা ও সামঞ্জস্য বিধান করে। বিবর্তনবাদ অনুসারে প্রথমে জলজ জীব হিসেবে ছোট কনিকা বা জেলির মতো কোষের উদ্ভব হয়। এর কিছু কিছু সাগরের নিচে মৃত বা জীবিত জমে শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের জন্ম দেয়, যা থেকে সমুদ্রের নিচের বৃক্ষরাজির উদ্ভব। ক্রমান্বয়ে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষ এবং স’লজ বৃক্ষ।
আবার ওই জেলিগুলোই ক্রমান্বয়ে মৎস্যজাতীয় প্রাণীতে রূপ নেয়। ছোট মাছ থেকে বড় মাছ। মৎস্য জাতীয় জলজ প্রাণী থেকে উভচর প্রাণীর উদ্ভব; যেমন-ব্যাঙ, কচ্ছপ। তার থেকে উদ্ভব সরীসৃপ প্রাণীর; যেমন-সাপ, টিকটিকি, ডাইনোসর এবং পেঙ্গুইন, এমু, উটপাখি প্রভৃতি পাখির, যা পরবর্তীতে পূর্ণ পাখিতে রূপান্তরিত হয়। আবার, সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী বৃহদাকার প্রাণীর উদ্ভব হয়; যেমন- শূকর, বাঘ, হাতি, তৃণভোজী বৃহদাকার বিলুপ্ত প্রাণীসমূহের এরই একটা অংশ এ্যাপজাতীয় উপধারা; যেখানে গরিলা, বানর শিম্পাজি প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত।
এরই ধারাবাহিকতায় আদিম মানুষ ক্রমান্বয়ে সভ্য মানুষে বদলেছে। পক্ষান্তরে, সনাতন ধর্মের বা আর্যমতের শাস্ত্র শতপথ ও তৈত্তিরীয় সংহিতা কিংবা বায়ুপুরাণ বা সৌরপুরাণও তাই বলে। মূলত আর্যশাস্ত্রসমূহ বিবর্তনবাদের সমর্থন বা ইঙ্গিত পূর্বেই দিয়েছিল।
বিবর্তনবাদের সাথে সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহের অবতারের অনেক সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন:
১. জলজ প্রাণী (মৎস্য জাতীয়)-মৎস্য অবতার (মাছ)
২. উভচর প্রাণী (কচ্ছপ, ব্যাঙ, প্রভৃতি)-কূর্ম অবতার (কচ্ছপ)
৩. স্থলজ প্রাণী (শূকর, গরু, সিংহ প্রভৃতি)-বরাহ অবতার (শূকর)
৪. এ্যাপজাতীয় প্রাণী (শিম্পাজি বা বন্যদশার মানুষ)-নৃসিংহ অবতার
৫. মানবজাতি (বর্বরদশা)-বামন অবতার
৬. মানবজাতি (সভ্যতা)-রাম অবতার ও পরবর্তী মানুষ।
অর্থাৎ জলজ প্রাণীদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে ভগবানকে মৎস্যজাতীয় প্রাণী হয়েই প্রথমে জন্মাতে হয়েছে। এভাবেই উভচর প্রাণীর উদ্ভব হলে তিনি কচ্ছপ জাতীয় প্রাণী হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পরে স্থলজ প্রাণীসমূহের উদ্ভব হলে তিনি তাদেরকে উদ্ধার করতে অবতীর্ণ হন শূকররূপে।
পরবর্তীতে যখন স্তন্যপায়ী বা এ্যাপজাতীয় প্রাণীর উদ্ভব হয়, তখন থেকে বনমানুষ পর্যন্ত তাদেরকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। অর্থাৎ দেখতে ক্রমান্বয়ে মানুষের মতো হলেও পশুপ্রবৃত্তি বিদ্যমান ছিল তাদের খাদ্যাভ্যাস; বাসস্থান, যৌনক্রিয়া প্রভৃতিতে। ঠিক এরই পর ভগবান আসেন অর্ধেক নর (মানুষ)+অর্ধেক সিংহ (পশু)= নৃসিংহরূপ। পরবর্তীতে সভ্য মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অবতারের আবির্ভাব। বিবর্তনবাদের সাথে সনাতন ধর্মের অবতার তত্ত্বের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ধর্মভীরু সনাতন ধর্মের মানুষেরা কখনোই তার অবতারের অমর্যাদা হয় এমন কোনো কাজ করে না। তাইতো অবতারসমূহকে তারা যথাযথ মর্যাদায় পূজা করে থাকে। গরুর কথাই ধরা যাক। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করে থাকে গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৩৩ কোটি দেবতা রয়েছে। এভাবেই সনাতন ধর্মাবলম্বীর যুগের পর যুগ গরু সংরক্ষণ করে আসছে।
একইভাবে সংরক্ষণ করে আসছে বানর ও হনুমান। বাল্মিকী রচিত সনাতন ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ রামায়ণে বানর ও হনুমানের বিশেষ স্থান রয়েছে। রামায়ণ সম্পর্কে যারা জানেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন রাবণ যখন তার বোন সূর্পনখার নাক কাটার প্রতিশোধ নিতে সীতাকে হরণ করেন তখন সীতা উদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র সাগর বেঁধে রাবণের রাক্ষস বংশের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধে সাহায্য করেছিল হনুমান ও বানরসহ আরো অনেকে।
কথিত আছে রামচন্দ্র হনুমানকে চার যুগের অমর বর দান করেছিলেন। সেই থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় বাঁধনে বেঁধে ফেলেন হনুমান ও বানরদের। হনুমান ও বানরদের নানা ধরনের অত্যাচর মুখ বুজে সহ্য করে তারা। অনেক স্থানে হনুমান ও বানরদের খাওয়ানো হয় পুণ্যিলাভের আশায়। ভারতবর্ষের অনেক মন্দিরসহ নানা স্থানে বানর ও হনুমানের উপস্থিতি বিষেশভাবে মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।
রামায়ণেরই আরেক চরিত্র জটায়ু পাখি। ধর্মভীরু এই পাখিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। যখন রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যায় তখন পথের মধ্যে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল জটায়ু পাখি। সে বারবার নানাভাবে রাবণকে নখ ও লম্বা ঠোঁট দিয়ে আক্রমণ করে সীতা হরণ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু রাবণ যখন কোনোক্রমেরই গরুড়ের কথা শুনছিল না এবং তার আক্রমণ যখন অসহ্য হয়ে ওঠে বাধ্য হয়ে রাবণ জটায়ুর বিশাল পাখনা কেটে দেয়। পরবর্তীতে রামের কাছে জটায়ু পাখিই সীতাকে হরণ করা হয়েছে সে তথ্য জানায়। এ জন্য জটায়ু পাখি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে নমস্য।
ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণের প্রশ্নে প্রাচীন ভারতবর্ষের ঋষিরা বলেছেন, প্রকৃতির মাঝেই ভগবান বিদ্যমান-জড় প্রস্তর খ- থেকে শুরু করে গাছ-পালা পশু-পাখি সবকিছুতেই তার (ভগাবানের) ছায়া আছে। তাদের এ কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে অক্ষম মানুষের দ্বারা গাছ ও পাথর হয়ে গেছেন ভগবান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য গাছপালা ভগবানের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছে। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গাছ, পাহাড়, গরু, ব্যাঙ, সাপ, অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি পূজা করে থাকে। পূজার মূল কারণ জীববৈচিত্র্য পৃথিবীতে অক্ষুন্ন থাকা।
পৃথিবী সবকিছু দ্বারা পরিচালিত হয়ে একটি সুশৃংখলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে কোনো কিছুর অভাব সেই শৃংখলের ছন্দপতন ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন গাছ ছাড়া কোনো জীবই বাঁচতে পারে না। বর্জ্যভূক পাখি ময়লা খেয়ে পরিবেশ ভালো রাখে। ধরা যাক একটি মানুষের হাত নেই কিংবা পা নেই। নিশ্চয় তার দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করতে নানা ধরনের বেগ পেতে হবে। তেমনি পৃথিবী যে শৃংখলের মধ্যে এগিয়ে চলে তার একটি যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে পৃথিবীর এগিয়ে চলার পথ বন্ধুর হবে এটাই স্বাভাবিক।
সনাতন ধর্মে গাছ উপাস্য। বর্তমানের মতো প্রাচীন বাংলায়ও নারীদের মধ্যে ভোরে উঠে তুলসি, শেওড়া ও বটগাছ পূজার প্রচলন ছিল। গ্রাম-দেবতার সাথে গাছ পূজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একেকটি গ্রামে যে গাছের নিচে আঞ্চলিক দেবতার পূজা হতো কোনো কোনো সময় সেই গাছটিরও পূজা করা হতো। ভারতবর্ষের এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে বট-পাকুড় কিংবা প্রাচীন গাছকে ভক্তিভরে পূজা করা হয়। সিঁদুর পড়ায় নানা ধরনের মানত করে। সূতা বাঁধে মনের ইচ্ছা পূরণ হওয়ার জন্য।
প্রাচীনকালে পুকুর খনন, পানীয় জলের জন্য কূপ খনন ও গাছ রোপণ ধর্মীয় কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ধারণা করা হতো গাছ হচ্ছে ঈশ্বরের আশ্রয়স্থল। বট ও পাকুড় গাছ লাগালে পুণ্য হয়। পিপল গাছকে প্রজাপতির আশ্রয়স্থল বলা হতো। আমগাছকে পঞ্চপাল্লাভা বলা হতো। আগনীপুরাণে একটি বৃক্ষকে ১০ জন পুত্রের সমান বলে অভিহিত করা হয়েছে।
সনাতন ধর্মবলম্বীদের তুলসি, কদম, নিম, বেল, চন্দন, তমালসহ নানা গাছের ওপর দুর্বলতা রয়েছে। এ সব গাছকে তারা শ্রদ্ধা করেন। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন মন্দিরগুলোর পাশে এসব গাছের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসিকে সীতাস্বরূপা, স্কন্দপুরাণে লক্ষ্মীস্বরূপা, চরকসংহিতায় বিষ্ণুর মতো ভূমি, পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ণুপ্রিয়া, ঋগ্বেদে কল্যাণী বলা হয়েছে। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু তুলসিদেবীকে পবিত্রা বৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন। তাই হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত কৃষ্ণ ও রাধা তুলসি এই দুই ধরনের তুলসি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে। সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
“না পুড়াইও রাধা-অঙ্গ,
না ভাসাইও জলে,
মরিলে তুলিয়া রেখো
তমালেরই ডালে।”
রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের সুখ-দুঃখের সাথী ছিল তমাল গাছ। রাধা এবং কৃষ্ণ অনেক অনুযোগ, অভিযোগ, ভালোবাসার কথা এই তমাল গাছের কাছে বলেছেন। এই কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তমাল গাছকে পবিত্র গাছ হিসেবে মনে করে থাকে।
বরষার কদম গাছও শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম সঙ্গী ছিল। বৃন্দাবনে কদম গাছের নিচে বসে কৃষ্ণ বাঁশিতে রাধাকে ডাকতেন। তাই এ গাছের কদর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কম নয়।
শাস্ত্রীয় মতে ‘বিল্ব’ বা বেলগাছ লাগালে সেই বাড়িতে পুরুষানুক্রমে ধনসম্পদে পরিপূর্ণ থাকে। এছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেলপাতা ছাড়া কোনো পূজা-অর্চনা হয় না। হোম-যজ্ঞ করার সময়ও বেলকাঠের প্রয়োজন হয়। বেলগাছ পবিত্র গাছ হিসেবে তারা এটিকে সংরক্ষণ করে থাকে।
নিম গাছ যেমন ওষুধি গাছ হিসেবে পরিচিত তেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র গাছ হিসেবে পরিচিত। এর কাঠ দিয়ে বিভিন্ন যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। এছাড়া চন্দন গাছ, বিভিন্ন ফুলের গাছ, দুর্বা ঘাসসহ নানাভাবে সনাতন ধর্ম প্রকৃতিকে আগলে রেখেছে। এছাড়া ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মালম্বীরা অশ্বত্থ, ডুমুর, বট, পাকুড় ও আমকে পঞ্চবৃক্ষের মধ্যে গণ্য করে থাকে।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে এর মধ্যে অশ্বত্থের স্থান সর্বশীর্ষে। অশ্বত্থ গাছ কাটলে বংশহানি হয়। তবে হোম-যজ্ঞের মতো পবিত্র কাজের জন্য অশ্বত্থ গাছের কাঠ কাটলে কোনো দোষ হয় না, বরং অক্ষয় স্বর্গ লাভ হয়। অশ্বত্থ গাছ পূজা করলে সকল দেবতার পূজা করা হয়।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে করচগাছের নিচে ‘থান’ তৈরি করে করচগাছেরই পূজা করা হয়। সেখানে করচগাছ মাসের পর মাস হাওরের পানিতে ডুবে বেঁচে থেকে মাছকে আশ্রয় দেয়, মাটির ক্ষয়রোধ করে, ¯্রােতের বেগ কমিয়ে দেয়। তাই গ্রামবাসী করচগাছকেই রক্ষক গণ্য করে পূজা দেয়। আবার দক্ষিণাঞ্চলে দুর্গাপূজার তালনবমী তিথিতে অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পানের বরজে কলার খোলে পাকা কলা, আতপ চাল, ফুল ইত্যাদি দিয়ে প্রতিদিন নৈবেদ্য দেয়া হয়।
শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই না, সারাদেশেই কুদৃষ্টি থেকে শিম, লাউ, কুমড়া রক্ষা করতে মাচানের মাটির হাঁড়িতে কয়লা ও চুন দিয়ে মানুষের চেহারা এঁকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়।
সনাতন ধর্মের মানুষেরা পাহাড়-পর্বত অলৌকিক শক্তির অধিকারী বলে পূজা করে থাকে। হিমালয়ের কথাই ধরা যাক। হিমালয়ে মহাদেব তপস্যা করেছেন। আবার হিমালয় কন্যা বলা হয় পার্বতীকে। আবার এই হিমালয়ই দেবী দুর্গাকে সিংহ দিয়েছিলেন মহিষাসুরকে বধ করার জন্য। এখনো হিমালয় সনাতন ধর্মের সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে এক মহা পবিত্রস্থান। তারা সেখানে ভগবানের তপস্যা করেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন মন্দির ও প্রার্থনার জায়গা হলো পাহাড়-পর্বতে। বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে রয়েছে শিবের মন্দির। মহেশখালী চ্যানেলের তীরে মৈনাক পর্বতের ২৮৮ ফুট ওপরে রয়েছে আদিনাথ মন্দির। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে জেলার লাকসাম-বরুড়া-সদর উপজেলার ত্রিমুখী মিলনস্থলে পাহাড়চূড়ায় রয়েছে চ-ি ও শিব মন্দির। এমনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন পাহাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির রয়েছে।
সনাতন ধর্মের মানুষের কাছে গঙ্গা নদী মহা পবিত্র নদী হিসেবে বিবেচিত। তাদের বিশ্বাস গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করলে আর কোনো পাপ থাকে না। তাই এই নদীকে তারা দেবীজ্ঞানে পূজা করেন। রক্ষণাবেক্ষণে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। গঙ্গা ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদও হিন্দুদের কাছে এক মহা পবিত্র নদ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া যমুনা, কৌশিকী, চন্দ্রভাগা প্রভৃতি নদী সকল পাপ নাশ করে বলে নদীর কোনো ক্ষতির কারণ হোক এমন কাজ তারা করে না।
প্রাচীনকালে ধ্বজা পূজা হতো। ‘ধ্বজা’ শব্দের অর্থ হলো পতাকা বা নিশান। এখানে ‘ধ্বজা’ বলতে প্রাচীন বাঙলায় ভিন্ন ভিন্ন কোম ও গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্বকারী ভিন্ন ভিন্ন পশু-পাখি ও পৌরাণিক প্রাণী বোঝানো হয়েছে। কোম ও গোষ্ঠিগুলোতে গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ূরধ্বজা, কপিধ্বজা, সিংহধ্বজা, হংসধ্বজা, নন্দীধ্বজা, পেঁচকধ্বজা, মকরধ্বজা ইত্যাদি ধ্বজা পূজা প্রচলিত ছিল। মীন, গরুড়, ময়ূর, সিংহ, হাঁস, পেঁচা সেইসব কোম অথবা গোষ্ঠির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর কোম অথবা গোষ্ঠির যিনি নেতা তিনি মীনধ্বজ, পেঁচকধ্বজ, হংসধ্বজ, সিংহধ্বজ, মকরধ্বজ ইত্যাদি নামে পরিচিত হতেন।
সময়ের পরিবর্তনে ধ্বজাপূজা হারিয়ে গেলেও ‘ধ্বজা’ হারিয়ে যায়নি বরং মূলস্রোতে মিশে গিয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর বাহন হিসেবে। যেমন জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর বাহন হাঁস, ধনের দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, যমের বাহন মহিষ, শিবের বাহন বৃষভ, দুর্গার বাহন সিংহ, গণেশের বাহন ইঁদুর, কার্ত্তিকেয়র বাহন ময়ূর, ষষ্ঠীর বাহন মার্জ্জার, অগ্নির বাহন ছাগল, বিশ্বকর্ম্মার বাহন হস্তী, পবনের বাহন মৃগ, ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, সূর্যের বাহন অশ্ব, শীতলার বাহন গাধা। বিচিত্র প্রকৃতির দেবতার সাথে বিচিত্র ধরনের বাহন। এছাড়া সাপকে সনাতন ধর্মে আলাদা মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। প্রাণিকুলকে রক্ষার জন্য প্রত্যেক দেবদেবী এক একটি বাহন নিয়েছেন, যা আমাদের ইকোসিস্টেমকে রক্ষার কাজে সহায়তা করে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রত্যেক পূজাতেই গাছ-পালার ব্যবহার রয়েছে। যেমন বেল পাতা, তুলসি পাতা, কলার পাতা, বট পাতা, অশ্বত্থ পাতা, আম পাতা, ধান, ডাব, দুর্বাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, ফলসহ প্রকৃতির সব কিছুকেই ব্যবহার করতে বলেছে সনাতন ধর্ম। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতি সংরক্ষণ করা।
সনাতন ধর্ম একদিকে যেমন পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, পশু-পাখি রক্ষা করে তেমনি নদ-নদী সংরক্ষণেও ধর্মীয় নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারপরও অজ্ঞতা ও স্বার্থপরতার কারণে অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনকে পাশ কাটিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানুষের অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতিকে ধ্বংস নয়, তাকে রক্ষা করতে হবে। তাহলেই আমাদের আগামী হয়ে উঠবে সুন্দর ও মধুময় ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
বহুমাত্রিক.কম