Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩২, শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫

আবাবিলের কান্না

আ ন ম আমিনুর রহমান

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৭ মার্চ ২০১৪

আপডেট: ১১:৫৭, ৩ জুন ২০১৪

প্রিন্ট:

আবাবিলের কান্না

ঢাকা: একসময় পুরানা পল্টনের বিদ্যুৎ অফিসে আমার বেশ আসা-যাওয়া ছিল। বিকেলবেলা আবাবিলদের ওড়াউড়ি ও ভেন্টিলেটরের বাসার ভেতর ফুরুৎ ফুরুৎ আসা-যাওয়া দেখতে ভালোই লাগত। একবার অতি দ্রুত গতিতে বাসায় ঢুকতে যেয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে একটি আবাবিল মারা পড়ল।ভাঙ্গা বাসা থেকে আবাবিলের উদ্ধারকৃত ডিম

তার নিঃষ্প্রাণ দেহটি হাতে নিতেই বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। সেখানেও আবাবিলদের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। বিকেলে ল্যাবের কাজের ফাঁকে গ্র্যাজুয়েট স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের ওড়াউড়ি দেখতাম। আবাবিলদের দ্রুতগতিসম্পন্ন বিরামহীন ওড়াউড়ি আমার উদ্যম ফিরিয়ে আনত।

আবাবিলের বাচ্চা পুনর্বাসনের জন্য সহকর্মীকর্তৃক বানানো বাসা।

পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) যোগদান করলাম। এখানে শিক্ষকদের রুমের মাঝখানের করিডোরে টিউবলাইটের হোল্ডারগুলো ছিল আবাবিলদের দখলে। তাই এদের ওড়াউড়ি বেশ উপভোগ করছিলাম। তবে এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০০৯-এর অগাস্টের এক দুপুরে খবর পেলাম স্টেট এন্ড ক্যাম্পাসের লোকজন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদে আবাবিলদের বাসাগুলো ভাঙছে।
 পুরানা পল্টনের বিদ্যুৎ অফিসে আবাবিল ও বাসা
বাসাগুলো ছিল আমার রুম থেকে অল্প দূরে। দ্রুত সেখানে গেলাম। যা দেখলাম তাতে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ইতোমধ্যেই সব ক’টি বাসা ভাঙা শেষ। কোনো কোনো বাসায় ডিম-বাচ্চা পর্যন্ত ছিল। এগুলোকেও রেহাই দেয়নি। একটি ভাঙা বাসায় দেখলাম চোখ না ফোটা তিনটি ছানা। ছানাদের মা-বাবা আশেপাশেই উড়ছে ও করুনসুরে কাঁদছে। দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল। আমি বুঝতে পারি না মানুষ কীভাবে এমন কাজ করতে পারে। স্টেট এন্ড ক্যাম্পাসের লোকজনকে বকাঝকা করতেই আসল কথা বেরিয়ে এলো।

আবাবিলের চোখ না ফোঁটা ছানা

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমার ঘনিষ্ট এক সহকর্মীর নির্দেশেই বাসা-ডিম-ছানা ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের অপরাধ মলমূত্রে করিডোর নোংরা করা। রাগে-দুঃখে মুখে যা এলো তাই বললাম সহকর্মীকে। এরপর বললাম ঠা-া মাথায় একটু চিন্তা করে দেখুন আপনি ঠিক কাজ করেছেন কি-না? যদি ঠিক কাজ করে থাকেন তাহলে ছানাগুলোকেও মেরে ফেলুন। আর না করে থাকলে এগুলোকে বাঁচানোর ও তাদের মা-বাবার কান্না থামানোর ব্যবস্থা করুন।

সহকর্মী তার ভুল বুঝতে পারলেন। অতপর ছানাগুলোকে একটি বাক্সে রেখে বাসাটা যেখানে ছিল তার পাশে ঝুলিয়ে দিলেন। অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। মা-বাবা বাক্সে রাখা ছানাদের কাছে গেল। খাবার খাওয়াল। এভাবে প্রতিদিন খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে একদিন নীল আকাশে উড়াল দিল। মনটা আনন্দে ভরে গেল। সহকর্র্মীর এই ভালো কাজটির জন্য তার খারাপ কাজটির কথা ভুলে গেলাম। এরপর সে আর কখনও পাখি উচ্ছেদ করেনি। তবে আবাবিলরা বিতারিত হওয়ার পর দু’বছরেও আর ফেরত আসেনি। কিন্তু বাউবির মিডিয়া সেন্টার ও অন্যান্য স্থানে বহাল তবিয়তেই আছে।

আবাবিলরা এদেশে ঘর বাতাসি (House Swift) বা ছোট বাতাসি (Little Swift) নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Apus affinis. এরা গাট্টাগোট্টা ও লম্বালেজী কালচে-ধূসর পাখি। লম্বায় ১৫ সে.মি. ও ওজনে মাত্র ২১ গ্রাম। পুরো দেহ কালচে-ধূসর পালকে আবৃত হলেও গলার নিচ সাদা। ডানা কিছুটা বাঁকানো কাস্তের মতো। মুখ গোলাপি, ঠোঁট কালো, চোখ বাদামি। পা ও পায়ের নালা গোলাপি-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ একই রকম।

আবাবিলরা উড়ন্ত পোকামাকড়, কীঁড়া, পাখাওয়ালা পিঁপড়া, উইপোকা, গুবরে পোকা, ছাড়পোকা ইত্যাদি খায়। উড়ন্ত অবস্থায় সিকসিকসিকসিক-সিক-সিক-সিকসিকসিকসিক স্বরে ডাকে। এপ্রিল-জুলাই প্রজননকাল। বাসা বাঁধে মানুষের বাসাবাড়ি, পুরনো ও ভাঙা দালান, ব্রিজের তলাসহ প্রভৃতি স্থানে। পালক ও উড়ন্ত ময়লা মুখের লালার সাথে মিশিয়ে বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি ২ থেকে ৩টি সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৪ থেকে ১৫ দিনে।

আলোকচিত্র: লেখক

আ ন ম আমিনুর রহমান

 

আ ন ম আমিনুর রহমান বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত প্রকৃতি, পাখি, প্রজাপতি ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক প্রবন্ধ লিখছেন ও আলোকচিত্র প্রকাশ করছেন।  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন (এমভিএসসি) এবং মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়াতে (পিএইচডি)।

পাখি ও প্রাণী চিকিৎসায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব গুয়েল্প থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার, চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক গ্রাহাম জ্যাকসন মেমোরিয়াল এওয়ার্ড (এএসআই) ও এমএসএপি এওয়ার্ড (মালয়েশিয়া) অর্জন করেছেন।
অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান বর্তমানে ‘পশুপাখির প্রজননতান্ত্রিক জৈবপ্রযুক্তি ও প্রজনন সংকট’ এবং ‘দুর্লভ ও বিরল পাখির প্রজনন প্রতিবেশ ও সংরক্ষণ’-এর উপর গবেষণা করছেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৩৩টি। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। সম্পাদনাকৃত বইয়ের সংখ্যা ৮টি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষ ও বিজ্ঞানকোষের সহলেখক। বাংলাপিডিয়াসহ প্রায় ২২টি গ্রন্থে তার আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি অ্যান্ড কনজারভেশন সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (১৯৯৬) এবং ‘প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সোসাইটি’ (২০০৯) নামে দু’টি সংগঠন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অনুষদের গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। বর্তমানে এই বিভাগসহ অনুষদাধীন আরও ছয়টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২৩১৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৪

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer