Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

পৌষ ১১ ১৪৩১, শুক্রবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ছায়াবিথী তলে শহীদের বেদীমূলে

বিপ্লব শেখ

প্রকাশিত: ০২:৪২, ২৯ মে ২০২৩

আপডেট: ১২:১৫, ২৯ মে ২০২৩

প্রিন্ট:

ছায়াবিথী তলে শহীদের বেদীমূলে

বাহাদুর শাহ পার্কে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্তম্ভ। -লেখক

সেই বার নিয়ে আমার ঢাকা আসার কত বার হল তা ঠিক বলতে পারব না। একসময় জেলা শহর গাজীপুরের চৌরাস্তা পেরুলেই মনে  হতো বোধহয় ঢাকা চলে এসেছি। কিশোর মনে বড়জোর উত্তরাকেই মনে হতো রাজধানী ঢাকা। তবে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে যখন ঢাকায় পা বাড়ালাম স্নাতকে ভর্তি হতে, আমার পেছনে পড়ে রইল ভাওয়ালের বনাঞ্চল ঘেরা কাওরাইদের শ্যামল জনপদের মায়া, অন্যদিকে অজানাকে জানবার ব্যাকুলতায় এক চাপা উত্তেজনা।

কয়েক কলেজে ভর্তির চক্কর কাটিয়ে শেষমেশ পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজেই ঠাঁই হলো আমার। দুই বড় ভাইকে সঙ্গী করে সেদিন কলেজের ঠিক সামনে এসে যেন বিস্ময়ঘোর আমার কাটছে না। এতো মানুষের ভিড়! যানজট দেখেছি অনেক, কিন্তু মানুষেরও এমন জট হয় নাকি? দলে দলে মানুষ ছুটে চলছেন, নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছেন’ মুহূর্তেই দেখছি নতুন নতুন মুখ।

ভাইদের থেকে জানলাম, দেশের বহু জেলার মানুষ নদী পথে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে সদরঘাট স্টিমারঘাটে ভিড় জমান প্রতিদিন। যানজটে পড়ে অনেকেই নেমে যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আর নজরুল কলেজের এই মোড়ে। নেমেই এক ক্ষদ্রাকৃতির ফিলিং স্টেশন চোখে পড়লো। লেখা আছে এটি নাকি ঢাকা শহরের প্রথম ফিলিং স্টেশন! অদ্ভুত তো! বিস্ময়ে চোখ মেলতেই সামনেই ছায়াঘেরা এক উদ্যানের মাঝে বিরাট এক সৌধ দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুলহল নিভৃত না করেই সেদিন ভর্তির নানা আনুষ্ঠানিকতা সারতে কলেজে ঢুকে গেলাম। আগ্রহ রয়ে গেল সেই সৌধের প্রতি। 

গেল কয়েক মাস কেটে কেছে কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে চেনা পরিচয় হতে। তবে ব্যস্ত শহরের এই প্রাঙ্গনে অদ্ভূত এক মায়ায় এ উদ্যান আমাকে বার বার টেনে নিয়ে গেছে সেখানে। হয়তো এই পার্কটি অনেকেরই চেনা। এর নাম এখন বাহাদুর শাহ পার্ক, ভারতবর্ষের শেষ স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নামে। কিন্তু এই পার্ক ঘিরে যে বিরাট এক ইতিহাস রয়েছে, আমার মতো নবীন শিক্ষার্থীর জন্য তা জানার সামান্য সুযোগও নেই এখানে। কৌতুহল নিভৃত করতে অনলাইনে এর ইতিবৃত্ত জেনে রীতিমতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। ইতিহাসের এমন এক তীর্থস্থানের ইতিকথা তুলে ধরতে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাই নেয় নি। 

কিন্তু আমি এক অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম, পার্কটির অজস্র বৃক্ষের ছায়াতলে সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা অজস্র মানুষ, কেউ একাকী; কেউবা দলবেঁধে পরম শান্তির আশ্রয় খুঁজছেন। গ্রীষ্মের খরতাপে একটু শীতল হতে সবাই ছুটে আসছেন এখানে। বহু বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়ায় ক্লান্ত পথিকদের বরণেও যেন প্রকৃতির কার্পণ্য নেই! কৃষ্ণচূড়ার ফুলের ঢালি মাঝে মধ্যেই খসে পড়ছে পথচারীদের গায়ে। কেউবা কুড়িয়ে নিচ্ছেন সেই পুষ্পরাজি। তাদের মধ্যে অনেকে তার প্রিয়জনকে নিবেদন করছেন সেই ফুল। 

ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, পরাধীন ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে বহু প্রতিবাদী সেনাদের পার্কের সুউচ্চ সৌধের স্থানেই ফাঁসি দেওয়া হয়। দেশবাসীদের মনে ভীতি সঞ্চারে অনেক দিন ঝুলিয়ে রাখা হয় সেই সব হতভাগ্য সেনাদের নিথর দেহ। শহীদদের সেই বেদনাবিদূর স্থানটিই দীর্ঘদিন পরিচিতি পেয়ে আসছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক, ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর নামে। পরবর্তী কালের শাসকদের বোদোধয়ে এর নাম বদলে রাখা হয়, বাহাদুর শাহ পার্ক; যিনি এই বিদ্রোহী সিপাহীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতি জানিয়েছিলেন। যাকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে চরম অবমাননাকর ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিয়োগান্তক স্মৃতিবাহী এই পার্কের শহীদ বেদীমূলে শান্তির যে সুশীতল আবেশে সবাই আচ্ছন্ন হন তাদের সিংহভাগই বয়েসে তরুণ। দেখতে পেলাম-তাদের অনেকেই এই শহীদ বেদীতে সামান্য শ্রদ্ধা নিবেদনের ভ্রুক্ষেপ নেই। ব্যথিত মনে মনে হল, তাদেরই বা দোষ কি? কর্তৃপক্ষের তো উচিত ছিল এমন তীর্থস্থানের ইতিহাস যথাযথভাবে এখানে দৃশ্যমান রাখা। তাতে ইতিহাস পাঠের সঙ্গে তরুণমনে শ্রদ্ধা নিবেদনের আকাঙ্খাও প্রবল হতো। আমার আশা অচিরেই হয়তো কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে প্রয়াসী হবে। সেই সঙ্গে এই উদ্যান বরাবরের মতোই অজস্র পথচারীদের বরণে এমনি অকৃপণ থাকবে। শহীদ বেদীমূলে উৎসর্গ হবে অগণিত তরুণপ্রাণের শ্রদ্ধার্ঘ।    

লেখক: স্নাতক( সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা। 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer