ছবি: সংগৃহীত
দেশে ডেঙ্গু মোকাবেলায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ভৌগলিক ও জলবায়ুগত তারতম্যের কারণে বিদেশ থেকে আনা ডেঙ্গু পরীক্ষণ কীট কিংবা প্রতিষেধক হিসেবে আমদানিকৃত ভ্যাকসিন অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে কাজ না করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এখানকার ডেঙ্গুর বাহক মশা, আক্রান্তদের আচরণগত তারতম্যসহ অন্যান্য বৈচিত্র্য এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য পর্যালোচনার আলোকে পরীক্ষণ কীট, ভ্যাকসিন ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সামগ্রী উৎপাদন করতে হবে।
বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মলিকুলার এপিডেমিওলজি অফ ডেঙ্গু: বাংলাদেশ পার্সপেক্টিভ‘ শীর্ষক সেমিনারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ এই মতামত তুলে ধরেন। বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারের আয়োজক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম। সেমিনারে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিথযশা কয়েকজন গবেষক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উপায় ও প্রাসঙ্গিক অনেক গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করেন। আয়োজনের গণমাধ্যম সহযোগি ছিল বিশেষায়িত অনলাইন নিউজপোর্টাল বহুমাত্রিক.কম (bahumatrik.com) ।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রামের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব এইচ সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় সেমিনারে অংশ নেন-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, ওএমসি হেলথকেয়ার লিমিটেডের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কায়সার মান্নোর, আইসিডিডিআর বি’র বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ড. মো. গোলজার হোসেন উজ্জ্বল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রামের প্রভাষক আকাশ আহমেদ।
ওএমসি হেলথকেয়ার লিমিটেডের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কায়সার মান্নোর সেমিনারে বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও এতে আক্রান্তদের প্রাণহানি সাম্প্রতিক বছরে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এই সময়ে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাতে বাইরের ওপর (বিদেশ নির্ভরতা) নির্ভর করা যাবে না। ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসায় যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি তাতে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, এখানে রোগটির ডাইমেনশন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। মিউটেশনও অনৈক বেশি। যার ফলে আমদানিকৃত পরীক্ষণ কীট কিংবা ভ্যাকসিন অনেকক্ষেত্রেই যথাযথভাবে কাজ না করার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।’
‘আমরা প্রতিবেশি দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে হয়তো খানিকটা সাদৃশ্য পেতে পারি, কিংবা দক্ষিণ ভারতের সঙ্গেও তথ্যগত মিল পাব না। সে কারণে ডেঙ্গুর বাহক মশা, আক্রান্তদের আচরণগত তারতম্যসহ অন্যান্য বৈচিত্র্য এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য পর্যালোচনার আলোকে পরীক্ষণ কীট, ভ্যাকসিন ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত সামগ্রী উৎপাদনে আমাদের জোর দিতে হবে। নিজেদের গবেষণা সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে’-যোগ করেন ড. কায়সার।
রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ সবেচেয়ে বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে নাগরিক অসচেতনাকে দায়ী করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধানে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু সংক্রমণ ঢাকা সিটিতে সবেচেয়ে বেশি, সিলেটে সবচেয়ে কম। আক্রান্তদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা সবেচেয়ে কম, তবে নারীমৃত্যুর সংখ্যা বেশি। অপরদিকে আক্রান্তদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি এবং তারা মারাও যাচ্ছেন বেশি। এই পরিসংখ্যান আমাদের খুবই উদ্বিগ্ন করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি রাজধানীল বহুতল ভবনের বেজমেন্ট ও ড্রামে ডেঙ্গুর বাহক মশার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। বলা যায় ৪৪% সংক্রমণের জন্য বহুতল ভবনের বেজমেন্টের অপরিচ্ছন্নতাই দায়ী। তাই এবিষয়ে নাগরিকদের সচেতন হওয়া জরুরি।’
গবেষকরা মনে বলছেন, শুধুমাত্র এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণঘাতী ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গুর সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত মলিকুলার ডায়াগনস্টিক কিট, ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ সনাক্তকরণ, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা উদ্ভাবন এবং ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিকিৎসা খুবই জরুরি।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর দেশে মোট ১ হাজার ১০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার-মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় আরও ১৩ জনের প্রাণহানির খবর দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৮ হাজার ৬০২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২ হাজার ৬৮৩ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৯১৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৯ হাজার ৪৬০ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩১৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ লাখ ১৯ হাজার ৬৮ জন। ঢাকায় ৮৬ হাজার ৭৭ এবং ঢাকার বাইরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৯১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার আজ