ছবি: সংগৃহীত
নব্বইয়ের দশকের কথা। ময়মনসিংহের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বীরখারুখায় তখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী ডামাঢোলে সরগরম। ভোটারদের কাছে নির্বাচনের পূর্বে এখনকার মতো বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছড়ানোর অভিযোগ তখনও উঠেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোটারদের সমর্থন পেতে সেই সময়কার প্রার্থীরা যে ‘বিনিময় প্রথা’ একদমই চালু করেননি তা কিন্তু নয়। সামর্থ্যের মধ্যে প্রার্থীরা ভোটারদের মন যোগাতে আকিজ বিড়ি আর আনলিমিটেড চা পানের ব্যবস্থা রাখতে কার্পণ্য করতেন না।
স্মৃতি হাতড়ে মনে করতে পারছি, ভোটারদের মধ্যে যারা অপেক্ষকৃত ‘এলিট’, তাদের জন্য থাকতো ‘কে-টু’ সিগারেটও। আর এসবের লোভে প্রার্থীর বাড়িতে দিন-রাত ভিড় লেগেই থাকতো। বিন্দুর বাপ নামে একজনের কথা মনে পড়ছে, যিনি বিনামূল্যের এই চা ও বিড়ি সেবনের ‘সুযোগ’ দারুণভাবে কাজে লাগাতেন! আলী আহাম্মদ নামে এক মেম্বার প্রার্থীর বাড়ির উঠানে সারাদিনই তার চা পান চলতো, চলতো বিড়িতে সুখটানও।
দেখা গেল, অচিরেই দূরারোগ্য ব্যাধি ভর করলো সেই বিন্দুর বাপের শরীরে। বয়েসের গন্ডিতে বার্ধক্য আসবার কথা না থাকলেও ব্যাধি তাকে কাবু করে ফেলেছিল। খক্ খ্ক কাশি আর আমশয় তাঁর লেগেই থাকতো। অবশ্য বেশি দিন এই ব্যাধি তাকে কষ্ট দিতে পারেনি, বিনাচিকিৎসায় অচিরেই ইন্তেকাল করেন সেই বিন্দুর বাপ। মাতুলালয়ের ওই গ্রামটির কথা ফের আরও একবার মনে পড়লো। মনে পড়লো অকাল প্রয়াত সেই বিন্দুর বাপের কথাও। সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন সমন্বয়’ রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজন করেছিল ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’ শক্তিশালীকরণ সংক্রান্ত এক নাগরিক সংলাপের আয়োজন করেছিল।
সংস্থাটির এই সংলাপে যোগ দিয়ে দেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিকরা তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন তা শুনে মনে হয়েছে, জনহিতকর এই প্রচেষ্টাটি শুরু হতে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছি আমরা। রাষ্ট্র কিংবা সমাজের বোধোদয়ের এই বিলম্বের কারণেই হয়তো অগণিত বিন্দুর বাপের মতো অকাল মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই সংলাপে পৌরহিত্য করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান যে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন, সময়ের বিচারে তা কেবল প্রাসঙ্গিকই মনে হয়নি-এমন ভাবনাগুলোই হয়তো আমাদের টেকসই সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার হতে পারে।
তিনি যা বলছিলেন-তার সারমর্ম, এই যে নির্বাচনী বছরে আমরা পা দিয়েছি, এ সময়টাতে যদি আমাদের রাজনীতিবিদরা জনকল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে জনস্বাস্থ্যবান্ধব নির্বাচনী প্রচারণা চালাতেন; তবে তা টেকসই রাজনৈতিক সংস্কৃতির চমৎকার অনুষঙ্গ হতে পারতো। ড. রহমানের প্রস্তাব, এখন পর্যন্ত নির্বাচন মানেই বিড়ি-সিগারেট কিংবা পান-জর্দা বিতরণের হিড়িক। স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন প্রান্তিক-শ্রমজীবী মানুষগুলো নির্বাচনই প্রচারণায় এসব স্বাস্থ্যহানিকর অপদ্রব্য ভোটদানের উৎকোচ হিসেবে লুফে নিচ্ছেন। তামাকপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের এই নির্বাচনী মৌসুমগুলোতে রীতিমতো টার্গেট নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণনে সক্রিয় হয়ে উঠে।
ড. আতিউর রহমান রাজনীতির মানুষদের আহ্বান জানান, নির্বাচনী প্রচারণায় তামাকজাত এসব অপদ্রব্য ভোটারদের হাতে যেন তুলে না দেন তারা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান তামাক পণ্য সেবনের যে ভয়াবহ তথ্য আমাদের সামনে হাজির করেছে, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক যাঁরা হবেন তাদের এই সচেতন অভিপ্রায় আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি।
রাজনীতির মাঠে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ভিন্নমতকে সহ্য না করার প্রবণতাকে পাশে সরিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি তামাকের আগ্রাসন প্রতিরোধে একাট্টা হতে পারতেন তবে সত্যিকারর্থেই জনকল্যাণের প্রতি তাদের সংহতি আছে এটা প্রমাণিত হতো। রাজনীতির মানুষদের চিন্তাধারায় প্রগতি, বিজ্ঞানমনষ্কতা কিংবা আধুনিকতার যে সংকটের কথা তরুণদের মুখে শোনা যায়, এটি যে পুরোপুরি মিথ্যা তা বলা যায় না। রাজনীতি যদি জনকল্যাণ আর জনআকাঙ্খারই প্রতিফলন হবে, তবে জনস্বাস্থ্যের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে সোচ্চার হতে এতো বিলম্ব কেন হলো?
তবে আশার কথা, উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ রূপান্তরের অভিযাত্রায় তামাকের বিরুদ্ধে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গীকারও দিনে দিনে বাড়ছে। আইন প্রণেতাগণ বিলম্বে হলেও তাদের দায় অনুভব করতে পারছেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তামাকজাত পণ্য দেওয়ার কুপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজনীতিবিদদের প্রতি ড. আতিউর রহমানের আহ্বান ভেবে দেখা জরুরি। জনপ্রতিনিধি কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক তা জনগণের কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রমাণ দেওয়ার মোক্ষম সময় এখনি।
স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, তামাকজাত পণ্য সেবনের কারণে বিভিন্ন রোগে প্রতিদিন দেশে ৪৫০ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে তামাক সেবন করা মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ। তামাক সেবন না করেও এর পরোক্ষ শিকার হন ততোধিক মানুষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত করার অভিপ্রায় জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদে ১৫৫ জন সংসদ সদস্য ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’ সংশোধনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু তা তা সত্ত্বেও তামাককে ঘিরে দুষ্টচক্রের অচলায়তন ভাঙা যাচ্ছে না। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর খোড়া যুক্তি দিয়ে তামাক চাষ সম্প্রসারণ বন্ধ হচ্ছে না। সমতলের পর পার্বত্য জনপদে তামাকের করাল গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে কৃষি জমি।
উন্নয়ন সমন্বয়ের সংলাপে অর্থনীতিবিদরা তামাকের ক্ষতিকারক প্রভাব উপলব্ধিতে আনতে জনস্বাস্থ্য খাতে সরকারের আরও দায় নেওয়ার তাগিদ দেন। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, যখন সরকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের বড় দায়িত্ব গ্রহণ করবে ঠিক তখনই সম্যকভাবে তামাকের ক্ষতির বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আসবে। কেননা কেবলমাত্র তামাক সেবনের ফলে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় যখন রাষ্ট্রকে বিপুল অর্থ খরচ করতে হবে ঠিক তখনই এর আগ্রাসন বন্ধে কার্যকর দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাব।
তামাক সংশোধন আইনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল, তামাকপণ্যের সিএসআর নিষিদ্ধ করা, সিঙ্গেল স্টিক সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি বন্ধ, ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার মতো বিধান যুক্ত করা হলেও তামাকের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে জনগণকে রক্ষায় আরও বহু পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। সর্বোপরি, নতুন প্রজন্মকে যদি এই অপদ্রব্যের প্রভাব থেকে মুক্ত করা যায়, তাদের সচেতন করা যায়; তবেই হয়তো তামাকমুক্ত আগামীর বাংলাদেশকে আমরা কল্পনা করতে পারি।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম