ছবি: সংগৃহীত
কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান জীবনীশক্তি। দেশের বিপুল জনসংখ্যার সিংহভাগ এখনও গ্রামে বসবাস করেন। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে এদেশের ৮৭ শতাংশ গ্রামীন মানুষের আয়ের উৎস কৃষি।বর্তমান শিল্পবিপ্লবের যুগেও, দেশের মোট শ্রমশক্তির সবচেয়ে বৃহৎ অংশ এখনও কৃষিতে নিয়োজিত। শতকরা হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির অংশিদারিত্ব কমলেও খাদ্য নিরাপত্তা এবং জাতীয় পরিসরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূলে কৃষির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
যার ফলে কৃষি, জনগনের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। তাই গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্টির অর্থনৈতিক এবং জীবনমান উন্নয়নের জন্য কৃষির উন্নয়ন অপরিহার্য। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, কৃষির উৎপাদন ১০০ শতাংশ বাড়ালে দারিদ্রের হার ০.৫ শতাংশ হ্রাস পায়। অর্থনীতির অন্যান্য খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনে দ্বিগুন ভূমিকা রাখে। বিগত এক দশকে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৩.১ শতাংশ হারে। এ সময় দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে গড়ে ১.৪ শতাংশ হারে। এছাড়া কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠির খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার জনগনের খাদ্যের অধিকার অর্জন এবং পুষ্টিমান উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরণের ক্ষুধা নির্মূল করা, অপুষ্টি দূর করা, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সবধরনের সম্পদে ক্ষুদ্র কৃষকের হিস্যা প্রদান, কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে সরকার। উপরোক্ত প্রতিটি লক্ষ্য কৃষির সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক (গ্রোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-জিএইচআই) ২০২৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫টি দেশের মধ্যে ৮১তম। যেখানে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১২৫ টি দেশের মধ্যে ১১১তম। অর্থ্যাৎ ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। এর কারণ হলো, বর্তমান সরকারে গৃহীত কৃষিবান্ধব নীতির ফলে কৃষিজ উৎপাদনে বাংলাদেশ অসামান্য সফলতা অর্জন করেছে। সেটির উপর ভিত্তি করে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার এদেশকে ৭ শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষকরাই দেশের কৃষির মূল চালিকাশক্তি
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে দারিদ্র্য হ্রাসের একটি ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলেও দেশের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠির বেশির ভাগই গ্রামীণ কৃষক। আবার এসব কৃষাণ-কৃষাণীদের প্রায় ৮৯ শতাংশই ভূমিহীন ক্ষুদ্র-প্রান্তিক কৃষক। খানা হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ শতাংশ পরিবারই ছোট কৃষক পরিবার। প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারগুলো একত্রে দেশের মোট কৃষক পরিবারের প্রায় ৮৮ শতাংশ । অথচ তাদের মালিকানাধীন চাষযোগ্য জমির পরিমান মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে এই ছোট কৃষক পরিবারগুলোই আমাদের খাদ্য চাহিদার মূল যোগানদাতা। তাই দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু এই সমস্ত কৃষকরা দারিদ্র্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও নিজেরা সব সময় মূল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বাহিরে থাকেন। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই, শেখ হাসিনার জনদরদী সরকার এসকল ক্ষুদ্র কৃষকদের নানাবিদ প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিতে অধিকতর সমতাধর্মী ও বৈষম্যবিরোধী প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে যথার্থ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন।
কৃষকের ব্যাংকিং: প্রান্তিক চাষিদের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
যেহেতু দেশের অধিকাংশ কৃষকই ক্ষুদ্র কৃষক এবং খামার-আয়তন হিসাবে কৃষি উৎপাদনের প্রধানতম চালিকাশক্তিও তারা, সে হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ক্ষুদ্র কৃষকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে, যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিআয়ের এ সমস্ত মানুষদেরকে আর্থিক সেবার মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার ২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ১০ টাকার ব্যাংক একাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা ও অতি-দরিদ্র্য মহিলা, দুস্থ, ছিন্নমূল ও কর্মজীবি শিশু এমনকি ভিক্ষুকদেরও ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেয়া হয়। তারপর থেকে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে ১০ টাকা দিয়ে কৃষকের ব্যাংক একাউন্ট খোলার পরিমান দিন দিন বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, রাষ্টায়ত্ব ৮টি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ১০ টাকায় খোলা একাউন্টের সংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ ২৩ হাজার ৭৪৮টি। যার মধ্যে কৃষকের একাউন্ট ৯৮ লাখ ৮৬ হাজার ৮৪৭টি। এপর্যন্ত মোট ৫৭৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে এসব কৃষকদের একাউন্টে।
ব্যাংক একাউন্টের সুবিধা
ইতিপূর্বে দেশের আর্থিক সেবাগুলো ক্ষুদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষের জন্যে কখনো সহজলভ্য বা উপলব্ধ ছিলো না। সাধারণতঃ রাষ্ট্রীয় বা বানিজ্যিক ব্যাংকে একটি একাউন্ট খুলতে একজন সাধারণ মানুষকে ন্যূনতম ৫০০ টাকা বা তার অধিক দিতে হয়। সেখানে, একজন কৃষক মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারছেন । অন্যান্য একাউন্টের মত এসব একাউন্টের নূন্যতম কোন স্থিতি রাখার প্রয়োজন নেই। বাড়তি কোন চার্জও আরোপ করা হয় না। তাই ১০ টাকার একাউন্টধারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি একাউন্ট রয়েছে এসব ক্ষুদ্র কৃষকদের। এর মাধ্যমে সমাজের এ সমস্ত অসুবিধাগ্রস্থ ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আর্থিক পরিষেবা সরবরাহ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রদত্ত প্রণোদনা ও ভর্তুকির অর্থ কৃষকের কাছে সরাসরি পৌছে দেয়া হচ্ছে এই একাউন্টের মাধ্যমে।
১০ টাকার একাউন্টধারী দুস্থ কৃষকদের মধ্যে বীজ ও সারসহ নানা উপকরণ বিতরণ করছে সরকার। তাছাড়া, এ সমস্ত কৃষকরা সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানে অংশ নিতে পারছে। অনেকে এই একাউন্টের মাধ্যমে জীবনে প্রথমবারের মতো ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ নিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রবাসী আয়ও আসছে এই একাউন্টের মাধ্যমে এবং উদ্বৃত্ত টাকা এই একাউন্টে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় রাখছেন। ফলে বিগত বছরগুলোতে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেড়েছে কয়েকগুন। এই অ্যাকাউন্টের ব্যবহার শুধু সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত করতে সাহায্য করেনি, তাদের জীবন পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃষকের ১০ টাকার ব্যাংক একাউন্ট অন্তর্ভুক্তমূলক অর্থনীতির একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। সাশ্রয়ী মূল্যে নি¤œ আয়ের মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে সরকারের উদ্যোগের প্রত্যক্ষ সুফল পাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। ব্যাংকের এসমস্ত একাউন্টধারীরা একদিকে যেমন আর্থিক সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন, অন্যদিকে এসব একাউন্টের মাধ্যমে সরকারের অর্থ সহায়তাও ঠিকঠাকভাবে পাচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে উঠছে। এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের জীবনমান এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের পালে ধীরে ধীরে হাওয়া বাড়ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন জাতির পিতার সূযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ তা বাস্তবে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। তার মানবিক কর্মসূচি কৃষি ভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
লেখক: পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়