ছবি: সংগৃহীত
বিষয়টি স্পষ্ট যে গত দু’বারের জাতীয় নির্বাচনে গঠিত হওয়া ভারতীয় জনতা পার্টির ব্র্যান্ড ‘মোদি সরকার’ এবং রোববারে মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গঠিত ‘এনডিএ সরকারের’ মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিঃসন্দেহে এ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে বিজেপির এবারের জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া।
২০২৪ এর জাতীয় নির্বাচনের পর ভারতে গঠিত হল এনডিএ র জোট সরকার। নির্বাচনের ফলাফলের ঘোষণার ঠিক পরেই সকল দেশবাসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘এনডিএ জোট আবার সরকার গঠন করতে চলেছে এবং বিজেপি এককভাবে সকল বিরোধীদের মিলিতভাবে তৈরি করা জোটের থেকেও বেশি ভোট পেয়েছে।’ পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় যে, বিজেপি এবারে পেয়েছে ২৪০ টি আসন এবং প্রায় ২৮ টি বিরোধীদলের মিলিত জোটের (ইন্ডিয়া জোট) আসন সংখ্যা ২৩২ টি এবং দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দল হিসেবে উঠে আসা কংগ্রেস পার্টি পেয়েছে ৯৯টি আসন।
হিসেবটা দাঁড়ালো যে, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে তৃতীয় বারের মত সরকার গঠনে এনডিএ’র সহযোগী টিডিপি প্রমুখ চন্দ্রবাবু নাইডু ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের অর্জিত মোট ২৭টি আসন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করেছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর এনডিএ র এক বিশেষ বৈঠকে, নতুন গঠিত সরকারে প্রধানমন্ত্রী মোদীকেই সর্বসম্মোতি ক্রমে জোটের নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বাচন করা হয়েছে।
কিন্তু চর্চার বিষয় হল, তৃতীয় বারের মত সরকার গঠন করলেও গত নির্বাচনে একক ভাবে ৩০০’র বেশি আসন পাওয়া বিজেপির এবার ২৪০ টি আসন পেয়ে জোটের শরিকদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। তবে কি ভারতের জনতা এবার নরেন্দ্র মোদিকে আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাননি?? বা জনতার সমর্থনকে এবার ইন্ডিয়া জোটের সাথে ছিল?? লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও, বিজেপি যেহেতু সর্বাধিক ভোট পেয়েছে, তাই এ কথা বলা উচিত হবে না যে জনগণ নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাননি। প্রায় ২৮ টি দলের ইন্ডিয়া জোটে শুরু থেকেই খুব একটা সংঘবদ্ধ পরিকল্পনা বা একসাথে লড়াই করার মানসিকতা কিন্তু বিশেষ একটা দেখা যায়নি, সুতরাং ইন্ডিয়া জোটকে ভারত সম্পূর্ণ সমর্থন করেছে সেটি একেবারেই বলা যায় না।
যে বিষয়টি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, ২০১৯ এর নির্বাচনে যখন ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলেই স্থানীয় দলগুলো নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল, সে জায়গায় এবারের নির্বাচনে সারা ভারতেই এই স্থানীয় দলগুলো খুবই ভালো ফল করে এবং তার সুবাদে ইন্ডিয়া জোটের আসন সংখ্যা বাড়ে। ভারতীয় জনগণ নরেন্দ্র মোদির গতবারের পূর্ণশক্তির সরকার ও দুর্বল বিরোধী পক্ষের কথা মাথায় রেখে এক মিশ্র মতামত এবারের ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে বলে বলা যেতেই পারে।
এবার দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি কিভাবে জোটের অন্যান্য সদস্যদের সাথে নিয়ে শাসনতন্ত্র এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, লোকসভায় বিরোধীপক্ষ শক্তিশালী হওয়ায় সরকারের পক্ষে যে কোন বিল পাশ করানো যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হয়তো অনেক যুগান্তকারী আইন যেমন ইউনিফর্ম সিভিল কোড এবার হয়তো বলবৎ করা যাবে না।
আবার এটিও নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকায় গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হবে। প্রাক নির্বাচনকালে অনেকের ধারণা ছিল, এবারের বিজেপি সরকারের শাসনে থাকা অবস্থায় ভারত যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখেছে, তাতে নরেন্দ্র মোদি সরকার আবারও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। অনেকের ধারণা ছিল, বিজেপি সরকারের সময়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা দলকে এবারের নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা দেবে। এমনকি গত এক তারিখে প্রকাশ করা এক্সিট পোল সমীক্ষাও কিন্তু সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে বন্দি থাকা ভোটের ফল চার তারিখে অনেক বিশেষজ্ঞদেরই চমকে দেয়। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে, বিজেপি এবার আশ্চর্য করার মতো খারাপ ফলাফল করে। এমনকি ফাইজবাদেও (অযোধ্যা যেই লোকসভা এলাকায় অন্তর্ভূক্ত) বিজেপিকে পরাজিত হতে হয়। দক্ষিণ ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় দল গুলোর রমরমা দেখা যায়, বাংলায় যেখানে বিজেপি গতবারের ১৮ টি আসনের জায়গায় এবার তাদের শুধুমাত্র বারটি আসন পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ও তৃণমূল কংগ্রেস ২৯ টি আসন পেতে সক্ষম হয়। তামিলনাড়ুতেও বিজেপির ফলাফল খুবই হতাশাজনক। অপরদিকে আবার বিজেপির প্রাপ্তির দিকগুলো যদি দেখা যায়, তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল উড়িষ্যায় খুবই ভালো ফলাফল করা। উড়িষ্যায় যেহেতু লোকসভার সাথে সাথে বিধানসভারও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে বিজেপি ক্ষমতায় থাকা বিজু জনতা দলকে পরাজিত করে এই প্রথমবারের মতো উড়িষ্যায় সরকার গঠনে সমর্থ হয়। কেরলেও একটি আসন পেতে বিজেপি প্রথমবারের মতো সক্ষম হয়।
এবারের নির্বাচনের ফলাফল সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক মহলকে ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তিশালী রূপটি আবারও একবার দেখাতে সক্ষম হয়। যেখানে প্রতি পাঁচ বছরের অন্তরে, শেষ কথা জনতাই বলে। তা সে সফল অর্থনৈতিক উন্নতির বিজ্ঞাপনই হোক আর জনগণের বহু প্রতীক্ষিত রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠায় হোক, ‘জনাদেশ’ ভারতে চিরকাল সর্বোপরি এবং শেষ কথা।
লেখক: ইতিহাস গবেষক ও কলকাতাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথইস্ট এশিয়ান হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ ফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা।