-লেখক
সামনে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোরবানি ঈদ সমাগত। সেজন্য একে বড় ঈদ বলা হয়। তাই এখন তিনটি জিনিস একসাথে সামনে চলে এসেছে। সেগুলো হলো কোরবানির উদ্দেশ্যে পশুর হাট, এরই মধ্যে চলছে বাঙালির শিকড়ের টানে বাড়ি ফেরার পালা। আর সেই সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে লাগামহীন যানজট। তাছাড়া মাত্র সদ্য সংঘটিত একটি বন্যার পানি নামছে এবং তাতে রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রতিবছরই ঈদ ফিরে আসে এবং সেইসাথে নিয়ে আসে কিছু আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। তবে সেখানে যত কষ্টই হোক সেটিকে যেন কেউ কষ্ট বলতে নারাজ। তাই আনন্দটাই সেখানে মুখ্য, কষ্টটা গৌণ।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য কষ্টের বিষয়গুলোও অনেকাংশে ঈদ-আনন্দের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ এখানে আনন্দ- বেদনা একটি আরেকটির পরিপূরক। যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের শিকড় গ্রামে গ্রোথিত, সেজন্য বছরের অন্য কোন কালে সময় পাক আর না পাক ঈদে বাড়ি ফিরতেই হবে। সেখানে প্রিয়জনদের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে হবে। তাই ঈদে বাড়ি ফেরার জন্য কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে থেকেই রেল, সড়ক, নৌ এবং আকাশপথে ঘরমুখো মানুষের জন্য অগ্রীম টিকেট বিক্রি শুরু করে দেয়। আর ঢাকাসহ বড় বড় শহরে কর্মরত কর্মজীবী মানুষ তাদের নিজ নিজ প্রাপ্তব্য সুযোগ বুঝে যাতায়াত শুরু করে।
অপরদিকে কোরবানি ঈদের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হলো পশু কোরবানি করা। সেখানে যদিও দুই সপ্তাহ আগে থেকেই পশুর হাট জমতে শুরু করে মূলত জোরেসোড়ে চলে ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই। অর্থাৎ যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর হাটগুলো বসে থাকে, ঠিক সেই একই সময়ে ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরা শুরু হয়ে যায়। দুটি বিষয়ের সাথেই মানুষের পরিচলন সম্পর্কিত। আর সেকারণেই বিষয়টি তখন একপ্রকার সাংঘর্ষিক হয়ে উঠে। কোরবানির পশুর হাটেরও যেমন গুরুত্ব রয়েছে তেমনি গুরুত্ব রয়েছে মানুষের বাড়ি ফেরা। আর সেকারণেই হচ্ছে রাস্তায় মারাত্মক যানজট। তবে এসবের সমন্বয় সাধন করতে পারলে হয়তো এতটা দুর্ভোগ হতো না।
সাধারণত যেসব স্থানে পশুর হাটগুলো বসে থাকে, কিন্তু কোরবানির পশুর হাট আর সেসব নির্ধারিত স্থানে সীমাবদ্ধ থাকেনা। আর পশুর হাটগুলো হয়ে থাকে কোন বাজার বা ছোট-বড় রাস্তার পাশে। সেজন্য পশুর হাটের মানুষ এবং ক্রয়বিক্রয়ের জন্য ভ্রাম্যমাণ পশুগুলোই তখন যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী। যতই প্রশাসন কিংবা সরকার অথবা স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে বলা হোক শৃঙ্খলার কথা। এক পর্যায়ে দেখা যায় আর কোন কিছুই ঠিক থাকছে না। কারণ ধরা যাক, কোন একটি সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তার অংশে ৩০টি বৈধ পশুর হাট বসাবে। কিন্তু প্রয়োজনের চাহিদা এবং স্থানীয় চাপে দেখা গেল সেখানে আরো কমপক্ষে ১০টি হাট অতিরিক্ত বসাতে হলো, তখন তাদের শৃঙ্খলা বিধানে সকলে হিমশিম খেতে হবে বৈকি।
অপরদিকে দেখা যায় রাজধানী ঢাকাসহ বড় বকড় শহরের কর্মজীবী মানুষের ছুটিও হতে থাকে এবং ঈদও সামনে আসতে থাকে। সেইসাথে কমতে থাকে যানবাহন। কারণ যেকোন ধরনের দুর্ঘটনা এবং অনাকাঙ্খিকত ঘটনা কমানোর জন্য সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ এক রুটের গাড়ি অন্য রুটে যেতে পারবে না, যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো যাবে না, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না, গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু ঈদ যখন একেবারে কাছে এসে কড়ায় নাড়ে তখন এসবের কোন কিছুই আসলে দেখার লোকই থাকে না। তাছাড়া এবারের দেশের একটি বিরাট অংশজুড়ে ভয়াবহ বন্যায় রাস্তাাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামো বিনষ্ট করার বিষয়টি রয়েছেই। আর এসবের ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া পরিণতিই হলো ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য যানজট এবং পরিশেষে জনভোগান্তি। এগুলো দেশের সবখানে সমানভাবে ঘটে না। ঘটে মূলত রাজধানী ঢাকা শহর থেকে বের হওয়ার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-দক্ষিণবঙ্গ, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, ঢাকা-পূর্বাঞ্চল এবং সর্বোপরি ঢাকা-ময়মনসিংহ ইত্যাদি সড়ক মহাসড়কে। কিন্তু রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা ভালো থাকলে এখন ঢাকা শহর যেমন ফ্লাইওভারে এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আওতায় সেজন্য যানজট অনেকটাই কমে আসছে।
অপরদিকে পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার ফলে এখন নদীপথে মাওয়া-কাওড়াকান্দি, আরিচা-দৌলতদিয়া ইত্যাদি নদীবন্দরে ফেরি চলাচলে তেমন সমস্যা সৃষ্টি হয় না। এগুলোর সম্মিলিত সমস্যার প্রতিফলনই হলো আসলে যানজট সমস্যা বা নিরসন। অথচ বর্তমান জনবান্ধব সরকারের সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সকল দায়িত্বশীল জায়গা থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে জনগণের এসব দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার একটি দেশে এসব পরিস্থিতিতে এসে আর কোন ফর্মূলাই কাজ করে না ঠিকমতো। সেজন্য প্রয়োজন এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নিজে থেকেই সচেতন হওয়া। যতদিন পর্যন্ত আমরা তা হতে না পারব ততদিন সরকার কিংবা একে ওকে দোষারূপ করে কোন লাভ নেই। তবে যেকোন মূল্যে ঈদের আনন্দময়তা কামনা করি।
লেখক: রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]