-লেখক
আজকের বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলের কাউন্সিল অধিবেশন করার জন্য কোথায়ও সরকার অনুমতি দেয়নি। পরে হুমায়ুন কবীর নামের জনৈক ব্যক্তি তার নিজের বাড়িতে সেই কাউন্সিল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ইতিহাসে সেই বাড়িটিই পুরান ঢাকার কেএম দাশ লেনের ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’। হলের মধ্যে একটু মতবিরোধ দেখা দিলে ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারীতে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দল ভেঙ্গে আলাদাভাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
সেই সময় আওয়ামীলীগের সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবই থাকেন এবং ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ কমিটিই বহাল থাকে। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক হন। তখন থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই কমিটি কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদেরই নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্দের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি হন শেখ মুজিবুর রহমান আর সাধারণ সম্পাদক হন মোঃ জিল্লুর রহমান। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতিত্ব ছেড়ে এএইচএম কামরুজ্জামানকে সভাপতি করা তখনও জিল্লুর রহমানই দলের সাধারণ সম্পাদক থাকেন।
তারপর ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে এ কমিটি ভেঙে একটি আহবায়ক কমিটি করা হলে সেই কমিটির আহবায়ক হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন। ১৯৭৮ সালে আব্দুল মালেক উকিল সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জক। এতে দলের মধ্যে মতভেদ, মতদ্বৈততাসহ সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দল পরিচালিত হতে সমস্যা হচ্ছিল ঠিক তখনই আলোকবর্তিকার মতো ১৯৮১ সালে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা এবং তিনি তখন দেশের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে একই বছর ১৭ মে ফিরে আসেন।
তখনও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক থাকেন। ১৯৮৩ সালে আব্দুর রাজ্জাক আবার আলাদা দল বাকশাল গঠন করে চলে যান। পরে ১৯৮৭ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি স্থির রেখে জিল্লুর রহমানকে পরপর দুইবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের বিশেষ কাউন্সিলেও একই কমিটি বহাল থাকে। উল্লেখ্য যে ১৯৮১ সাল থেকে দলের প্রয়োজনেই গঠনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে বারবার শেখ হাসিনাকেই সভাপতি করা হয়েছে। শুধু পরিবর্তিত হয়েছে সাধারণ সম্পাদক পদে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের আব্দুল জলিল এবং ২০০৮ ও ২০১২ সালে পরপর দুইবার সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে করেছেন।
ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর ২০তম সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হন ওবায়দুল কাদের। এরপর ২০১৯ সালে ২১তম সম্মেলনে টানা দ্বিতীয়বার এবং ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ২২তম সম্মেলনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বারের মাতো সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালীন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে কঠিন সময়ে ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে।
আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
২৩ জুন আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর সফলভাবে পার করা। আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামের একটি উদ্ভট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু প্রগতিশীলরা সে উদ্ভট বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। তারই অংশ হিসেবে ১৯৪৯ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জুন পূর্ববঙ্গ মুসলিমলীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল আয়োজন করেন। তখন সেদলের প্রথমসারির নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান পূর্ববাংলার একাংশকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
পরে এই সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুব্ধ পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কেএম দাশ লেনে অবস্থিত রোজগার্ডেন হলরুমে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। শেরে বাংলা সে সম্মেলনে ক্ষাণিক সময়ের জন্য উপস্থিত থেকে সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনেই পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়।
সেখানে সভাপতি হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। তখন শেখ মুজিব জেলখানায় থেকেই সেই দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট এ অর্গানাইজিং কমিটিতে ২৯ বছর বয়সী শেখ মুজিব সেদিন তাঁর যোগ্যতাবলেই দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হতে পেরেছিলেন। সেই কমিটির অন্যান্য কয়েকজন ছিলেন- সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ এমএলএ, অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান, ২ নং যুগ্ম-সম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ, সহ-সম্পাদক একেএম রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রমুখ।
পরে শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দলকে আস্তে আস্তে সংগঠিত করে ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্বপাকিস্তান আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে তিনিই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৪ মার্চ পূর্বপাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৩ আসন লাভ করে। তার মধ্যে শরিক আওয়ামীলীগ একাই পায় ১৪৩ আসন। ১৯৫৫ সালে ২১ অক্টোবর দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিব পুরোসময় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে আরেক নজির সৃষ্টি করলেন, যা রাজনীতিতে সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিব আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক হন এবং সেবছরই ছয়দফা ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৮ সালের ৩ মে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জনের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। এ সময় জেলে থেকেই শেখ মুজিব বাংলার মুকুটহীন স¤্রাটে পরিণত হন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগার থেকে মুক্তিপান এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।
এরপর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন আসে আওয়ামীলীগের দখলে। এগুলো ছিল স্বাধীনতার পূর্বেকার আওয়ামীলীগের সাফল্যগাঁথা। তারপর আওয়ামীগের হাত ধরেই দেশের স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যার বলি হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু নিজেই। তবে বাংলদেশের মানুষের কল্যাণে আজো তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরা পর্যন্ত আওয়ামীলীগকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে।
এ কথা খুব দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামলীগের জন্ম না হলে যেমন বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না, ঠিক তাঁর কন্যা দেশের হাল না ধরলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো না। বাংলাদেশ হয়তো সেই তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কাজেই আওয়ামীলীগের জন্যই বঙ্গববন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরীই আজকের দেশের কা-ারি দেশরতœ শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন তাঁর গড়া দল আওয়ামীলীগে নবীন-প্রবীণের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটিয়ে দলের জন্য একটি দেশের স্বাধীনতার মতো সাফল্য এনে দিয়েছিলে, জননেত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে বাবার পথ ধরেই দলে নবীন-প্রবীণের সমাবেশ ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামীলীগের সৃষ্ট বাংলদেশকে তাঁর স্বপ্ন মতো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আজ দীর্ঘদিন আওয়ামীলীগ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থাকলে দল ও সরকার অনেক সময় একাকার হয়ে যায়। সেজন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই আওয়ামীলীগকে পরিচালিত করতে হবে। ৭৫ বছর একটি রাজনৈতিক দলের বয়স সেটি কম কথা নয়। দেশে তো নয়ই বিশ্বে এত দীর্ঘদিন সফলভাবে একটি দল পার করেছে বা করছে এমন নজির খুবই কম। আওয়ামলীগের হীরকজয়ন্তীতে সরকার এবং দলের প্রতিটি ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীর জন্য রইল অফুরন্ত শুভাশীষ।
লেখক: রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]