ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিকদের হত্যা-নিপীড়ন কি এখন তাহলে মামুলি ঘটনা হয়ে গেছে? এমন প্রশ্ন প্রায়শই উঠছে। বর্বরতার সঙ্গে সাংবাদিক নিধনের দীর্ঘ তালিকায় শনিবার যোগ হলো আরও একটি নাম-স্বপন কুমার ভদ্র। ময়মনসিংহ সদরে শম্ভুগঞ্জ এলাকার মাঝিরপাড়া-টানপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, স্থানীয় মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণেই মাদকাসক্তদের হাতেই খুন হন তিনি।
গত কয়েক দশকে সাংবাদিকদের হত্যা ও নিপীড়নের পরিসংখ্যান এবং যে অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে, তাতে ক্রমাগতভাবেই গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য চরম অনিরাপদ একটি দেশ এখন বাংলাদেশ। রাজনৈতিক সরকার থেকে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তবর্তী-যাই বলি না কেন, সাংবাদিকদের অভিন্ন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই যেতে হচ্ছে। এর পেছনে এখন পর্যন্ত সহজবোধ্য ও স্বীকৃত কারণ যেটি তা হচ্ছে- বর্বরোচিত ঘটনাগুলির কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না বলেই দুর্বৃত্তরা বার বার এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর দুঃসাহস পাচ্ছে।
একটি রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশে গণমাধ্যমের অবদানকে কেউ অস্বীকার না করলেও বাস্তবে সেই রাষ্ট্র সাংবাদিকদের সুরক্ষার নূন্যতম নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির যে টালবাহানা আমরা দেখে আসছি তা এই অবস্থার ভয়াবহতাকে তুলে ধরতে যথেষ্ট।
রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরগুলিতে অবস্থান করা সংবাদকর্মীদের জন্য অপেক্ষাকৃত সুরক্ষাবলয় থাকলেও প্রান্তিক জনপদে দায়িত্ব পালন করেন যেসব সাংবাদিকরা; সেখানে বহু নিপীড়েনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, কিন্তু সব খবর গণমাধ্যমে আসছেও না-যতক্ষণ না তা হত্যাকাণ্ডে না গড়ায়। জনসমক্ষে হুমকি, কটাক্ষ কিংবা শারীরিক লাঞ্ছনার মতো ঘটনা অনেক সংবাদকর্মীই প্রকাশ্যে আনেন না এই ভয়ে যে তাহলে হয়ত শেষ রক্ষা হবে না।
আমরা বিগত দিনে রাজনৈতিক সরকারের আমলে সাংবাদিক নিপীড়নে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন-রাজনীতির এই দুই পক্ষকেই সমান ‘পারদর্শিতা’ দেখাতে দেখেছি। সাংবাদিকদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, নির্মোহভাবে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা বা প্রশ্নের মুখে দাড় করানো। এই জায়গাতে রাজনীতির দুই পক্ষই সাংবাদিকদের দিকে মারমুখি। বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় আমরা এও দেখেছি যে, সাংবাদিক হত্যা বা নিপীড়নের ঘটনার যথাযথ বিচার নিশ্চিতে কোন ভূমিকা না রেখে উল্টো আপসরফায় তৎপর হয়ে পড়েন একশ্রেণির সাংবাদিক নেতারা। বলতে দ্বিধা নেই যে, অপরাধীদের সঙ্গে গোপনে মিটিং করে সেই সাংবাদিক নেতারা বিচারের প্রশ্নে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, হয়তোবা তাতে তাদের ব্যক্তিগত বিশেষ সুবিধা হয়!
ঢাকায় সাংবাদিক-হত্যা ও নিপীড়নের প্রতিবাদে বহু মানবন্ধন বা সমাবেশে যোগ দিয়ে সাধারণ সংক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের কণ্ঠে এমন অভিযোগ বার বার শুনেছি। কিন্তু যারাই নির্বাচিত হয়ে পদে বসছেন তারা অধিকাংশই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
দেশে এখন একটি বিশেষ শ্বাসরুদ্ধকর সময় চলছে। অভ্যুত্থানে একটি রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। দেশজুড়েই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি, যদিও উন্নতির নানা চেষ্টা চলমান। শনিবার বেলা ১১টার দিকে নিজ বাড়ির সামনে সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্র খুনের ঘটনায় কয়েকটি দিক সামনে এসেছে।
পত্রিকার খবর বলছে, সুরতহাল রিপোর্টে পুলিশ কর্মকর্তা দেখতে পেয়েছেন হত্যাকারীর ধারালো অস্ত্রের কোপে স্বপন ভদ্রের একটি হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়েছে, গলায় অন্তত ৬টি কোপ। স্বজনরা দাবি করেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে লেখার জন্যই তার এই পরিণতি হয়েছে। স্বজনরা আরও দাবি করেছেন, হাত দিয়ে লেখার কারণে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে হাতের কব্জি।
ভাবা যায়, ষাটোর্ধ্ব একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে নিজ বাড়ির সামনে কিভাবে এমন বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করতে পারলো সন্ত্রাসীরা? সেই সমাজের কেউই কি ছিল না, যারা এগিয়ে এসে তাকে রক্ষা করতে পারতেন? মানুষের একসঙ্গে সহমর্মিতা ও সংহতির সঙ্গে পাশাপাশি বসবাসের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠে যে সমাজ-সেই সমাজকেও কি তবে আমরা হারিয়েছি। একে অপরের কষ্টে-দুর্বিপাকে এগিয়ে আসার যে প্রবৃত্তি আমাদের সমাজের ছিল তা ভেঙে পড়েছে-এতে সন্দেহ নেই।
সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্র মাদকের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন, সরব ছিলেন স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। তাকে এজন্য ইতিপূর্বে আক্রমণ করেছিল মাদক সন্ত্রাসী, দিয়েছিল হুমকিও। কিন্তু সত্য প্রকাশে নির্ভীক সাংবাদিক তা উপেক্ষা করবেন তাই স্বাভাবিক। স্বপন ভদ্র তাই করেছিলেন। সেজন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হল।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, সাংবাদিক স্বপ্নন হত্যায় এখন পর্যন্ত ১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে-দেশের প্রান্তিক জনপদে মাদকের যে বিস্তার তার পেছনের মূল ব্যক্তিরা কি এর জন্য আদৌ দায়ী হবেন? সমাজের টগবগে তারুণ্যকে যারা বিপথে ঠেলে দিয়ে নিজেরা অভিজাত জীবনযাপন করছেন তারা কি অধরাই থাকবেন? প্রশাসন কি তাদের চেনেন না?
আমরা বিশ্বাস করি না যে, মাদকের এই আগ্রাসনের হোতাদের প্রশাসন চিনে না। আর সমাজ ও দেশ পরিচালনা করা রাজনীতিবিদরাও যে তাদের প্রশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠেন তা কারও অজানা নয়। যে কারণে সাংবাদিক স্বপন ভদ্র নির্মমভাবে খুন হলেন-কয়েকজন ছিচকে মাদকসেবীকে গ্রেপ্তার করলেই এই হত্যার যথার্থ বিচার হবে না। সমাজ মাদকমুক্ত হবে না।
যদিও সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ তা সত্ত্বেও আমরা প্রত্যাশা করব, শম্ভুগঞ্জ এলাকায় মাদকের আগ্রাসনে জড়িত প্রভাবশালীরা যেন এই হত্যাকাণ্ডে শাস্তি পান। তা না হলে কোন দৃষ্টান্তই স্থাপিত হবে না। নিহত সাংবাদিকের তালিকা এভাবেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম