ড. নিয়াজ পাশা ((১৯৬৫-২০১৭)
বিশিষ্ট কৃষি প্রকৌশলী, কৃষি সাংবাদিক, গবেষক ও লেখক ড. নিয়াজউদ্দিন পাশার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন তিনি।
মো. নিয়াজউদ্দিন পাশা দেশের অবহেলিত হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার লাইমপাশা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে ৫২ বছর পূর্বে ১৯৬৫ সালে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে ইটনা থানা থেকে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক এ ভর্তি হয়ে ছিলেন কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে।
তারপর কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ শিক্ষার্থে চলে আসেন ময়মনসিংহে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখে ১৯৮৪-৮৫ সেশনে ভর্তি হন এ দেশের কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরী অনুষদে’।
আবাসিক হল হিসেবে বেছে নিলেন ফজলুল হক হল, থাকতেন ১২১ নং কক্ষে। সর্বদা সদালাপী ও পরোপকারী, সামজিকতায় অনন্যগুণ সম্পন্ন হওয়ায় তিনি নিজ হলে ও পরবর্তীতে পুরো ক্যাম্পাসে ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই তিনি জড়িয়ে যান লেখালেখিতে। বলতে গেলে তৎকালিন কৃষি সাংবাদিকতা শুরুটা হয় তার হাত ধরেই। তিনি কাজ শুরু করেন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায়। মজার ব্যাপার হলো মাওলানা আবদুল মান্নানের পত্রিকার সাংবাদিক হলেও তিনি ছিলেন পুরোমাত্রায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের একজন সাহসী কর্মী, ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও পরে নেতা ।
জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ছাত্রলীগের মনোনয়ন পেয়ে বাকসু (১৯৮৯-৯০) এর ফজলূল হক ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। শত ব্যাস্ততার মাঝে নিয়াজ পাশা কৃষি সাংবাদিকতায় পুরোমাত্রায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। চেষ্টা করেছেন সাংবাদিকতাকে জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে। বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নানামুখি কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখলেও কখনও ভুলেননি নিজ এলাকা হাওরের কথা। হাওরের প্রতি ছিল তার অসম্ভব ভালোবাসা, প্রবল টান ও অনুভূতি। সে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে নিজের নাম মো. নিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে তার নিজ গ্রামের নাম ‘লাইমপাশা’ নামের শেষাংশ জুড়ে দিয়ে তিনি পরিচিত হতে থাকেন নিয়াজ উদ্দিন পাশা নামে।
নিয়াজ পাশা কৃতিত্বেও সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন শেষে একজন কৃষি প্রকৌশলী হয়েও প্রাণের টানে, লেখালেখির প্রতি অসম্ভব টান বোধ থেকেই চেষ্টা করতে থাকেন সাংবাদিকতাকে, ফ্রিল্যান্স লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে। এ কারণে অন্য জায়গায় চাকুরির সুযোগ থাকলেও সে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ট্রেনিং, কমিউনিকেশন এন্ড পাবলিকেশন বিভাগে ‘বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা’ হিসেবে ১৯৯৪ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা।
প্রতিদিন বিভিন্ন দৈনিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল তার নানা প্রবন্ধ, কৃষির নানাবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনার সংবাদ ইত্যাদি। তার কাছ থেকে ক্যাম্পাসের নবীন সাংবাদিকরা অনুপ্রাণিত হতো। এক পর্যায়ে এ মেধাবী কৃষি প্রকৌশলী সরকারি বৃত্তি নিয়ে ২০০২ সালের ১৫ তারিখে ডিসেম্বর চলে যান উচ্চ শিক্ষার্থে মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়া হতে উচ্চতর পিএইচ-ডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে ২০০৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আবার বিনা’য় যোগ দেন। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরেও তিনি কৃষি সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে আরো বেশি মনোনিবেশ করেন। লেখালেখির অবারিত সুযোগ বিনায় ছিল না। এক রকম অসন্তুষ্টি নিয়েই সে পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখে ঢাকায় সার্ক এগ্রিকালচার সেন্টারে সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করেন । এরই মধ্যে ড.নিয়াজ পাশার লেখার সংখ্যা কয়েকশ থেকে হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
হওরের কৃষি ও কৃষকের দুঃখ দুর্দশার কথা অনবরত লিখতে থাকলেন তিনি পত্রিকার পাতায় ও অনলাইন পোর্টালে। তার লেখা কৃষি ও কৃষকের নানাবিধ সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে রচিত লেখা নীতিনির্ধারকদের নজর কাড়ে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অনগ্রসর হাওরের জন্য সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতেন তিনি। হাওরের কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। নিজে হুইল চেয়ার নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের রাস্তায় প্লেকার্ড বুকে জডিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছেন হাওরবাসীর উন্নয়নের দাবিতে। কিভাবে পরিকল্পিতভাবে এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন করা যায়। সে জন্য যেমন করে তিনি কলম চালিয়েছেন, আবার চালিয়েছেন প্রয়োজনীয় যোগাযোগ। এতে তিনি অনেক সফলতাও পেয়েছিলেন।
তিনি নিজেকে একজন ‘হাওর ভূমিপুত্র’ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। নিজের নামের শেষে লিখতেন ‘হাওর ভূমিপুত্র’। হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনেও তার অনেক অবদান রয়েছে।
নিয়াজ পাশা ২০১৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর গবেষণা ইনস্টিটিউট খোলার জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এর নিকট একটি চিঠি দেন। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশনকে সম্ভাব্য করণীয় ঠিক করতে নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশন যাচাই বাছাই করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। যার ফলে এ বিশ্বদ্যিালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পূর্ণ অনুমোদন লাভ করায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর ও চর গবেষণা ইনস্টিটিউট আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে একটি ম্যাসিভ ব্রেইন স্ট্রোকে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে বারডেম ও পরে ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে বুধবার দুপুরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে কোনো কথা বলতে পারেননি দেশের বিশিষ্ট এই কৃষিবিদ। বামপাশ অবশ হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রায় দুই সপ্তাহ সংজ্ঞাহীন থেকে ১০ জানুয়ারি ২০১৭ প্রয়াত হন। ড. পাশা বেঁচে থাকলে হয়তো পিছিয়ে পড়া হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশের কৃষিতে অরো অনেক অবদান রাখতে পারতেন।
২০১৫ সালে তার বাকৃবি সাংবাদিক সমিতি সংবর্ধনা দেয় ড. নিয়াজ পাশাকে। সর্বশেষ সম্মিলিত নাগরিক ফোরাম, কিশোরগঞ্জ কৃষিতে বিশেষ অবদানের জন্য ‘জোতির্ময় কিশোরগঞ্জ পদক-২০১৬’ লাভ করেন তিনি।